ভূমি সমস্যা-জোর আর জবরদখলের কাছে অসহায় পাহাড়িরা by মঙ্গল কুমার চাকমা

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক বলেছিলেন, ‘পাহাড়িরা অসহায়, আমি নিরুপায়।’ পাহাড়িদের জমিজমা জবরদখলের উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মদদে সেটেলার নামে পরিচিত বাঙালি বসতি স্থাপনকারী কর্তৃক ২০০৩ সালে সংঘটিত খুব সম্ভবত মহালছড়ি ঘটনার পর জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে এ কথা বলেছিলেন। এ কথা বলার দুই দিনের মাথায় খাগড়াছড়ি জেলা থেকে তাঁর স্ট্যান্ড রিলিজ হয়েছিল।


সেই অসহায় অবস্থা থেকে আরও করুণ দশা বিরাজ করছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের লাগোয়া বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও আলীকদমের আদিবাসী পাহাড়িদের বেলায়। রাবার ও প্লানটেশনের নামে অস্থানীয়দের কাছে প্রদত্ত ইজারা, ‘আর’ কবুলিয়তের নামে আশির দশকে সেটেলার বাঙালিদের দেওয়া বিধিবহির্ভূত বন্দোবস্তি এবং তথাকথিত বনায়ন ও সামরিক কাজের জন্য অধিগ্রহণ ইত্যাদির মাধ্যমে পাহাড়িদের প্রথাগত জুমভূমি, বন্দোবস্তকৃত বা ভোগদখলে থাকা হাজার হাজার একর জমি জবরদখল করা হয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়িদের কাছ থেকে নানা ছলচাতুরি ও দুর্নীতিগ্রস্ত ভূমি প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় জাল দলিলের মাধ্যমে পাহাড়িদের অনেক জায়গা-জমি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এসব ইজারাদার অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং প্রশাসনের উচ্চস্তরে তাঁদের রয়েছে সীমাহীন দৌরাত্ম্য। ফলে একটি প্লটে ২৫ একর জমি ইজারা নিলেও তাঁরা ৪০ বা ৫০ একর ভূমি জবরদখল করতে পারেন। পাহাড়িরা আপত্তি দিলে সন্ত্রাসী লেলিয়ে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ইজারাদারেরা তাঁদের উদ্যোগে আমিন-কানুনগো এনে ইচ্ছামতো ফিতা ফেলে পাহাড়িদের প্রথাগত জুমভূমি, বন্দোবস্তকৃত বা ভোগদখলে থাকা জমি জবরদখল করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে অব্যবহূত ভূমি ইজারা বাতিল করার বিধান থাকলেও তা আজও কার্যকর হয়নি। লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে অনেক বিস্তৃত এলাকায় এককালে মারমা-ত্রিপুরাদের ঘনবসতি থাকলেও বর্তমানে প্রায় শূন্য। এই ইউনিয়নে বর্তমানে ‘ম্রো’ অধিবাসীরা উচ্ছেদের মুখে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী মৌজাধীন চাকপাড়ার পূর্বদিকে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত এলাকায় রাবারবাগান করা হয়েছে।
এই বিস্তৃত অঞ্চলে রাবারবাগান গড়ে ওঠার ফলে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের জীবন-জীবিকা ভেঙে পড়েছে। এসব এলাকা মূলত সমষ্টিগত মালিকানাধীন মৌজাভূমি। বিস্তৃত মৌজাভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ার ফলে এ এলাকায় পাহাড়িদের জুমচাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁরা এখন রাবারবাগানে স্বল্প বেতনের দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। এককালে তাঁরা এসব প্রাকৃতিক বন থেকে গৃহস্থালির জন্য বাঁশ-গাছ-শণ সংগ্রহ করতেন। এখন আর কোনো বাঁশ-গাছ-শণ নেই। গাছ-বাঁশের অভাবে তাঁরা এখন মাটির তৈরি ‘গুদাম’ ঘর তুলতে বাধ্য হচ্ছেন। বাড়ির আঙিনায় টেংরা বা বেড়া পর্যন্ত তাঁরা দিতে পারছেন না। এককালে এসব বিস্তৃত মৌজাভূমি ছিল গোচারণের ক্ষেত্র। এখন গোচারণ ভূমির অভাবে গরু-মহিষ পালন করতে পারছেন না। এ এলাকার ছড়া-ঝিরি থেকে তাঁরা মাছ-ইছা-কাঁকড়া-শামুক সংগ্রহ করে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতেন। প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের ফলে এসব এলাকায় মাছ-ইছা-কাঁকড়া-শামুক তেমন পাওয়া যায় না। আগে পাহাড়ি নারীরা দু-একজনেই নিরাপদে মাছ-ইছা-কাঁকড়া-শামুক ধরতে যেতে পারতেন। এখন আর পারেন না অসাধু লোকদের পাশবিক লালসার শিকার হওয়ার ভয়ে। ইতিমধ্যে অনেকে এ রকম ঘটনার নির্মম শিকার হয়েছেন বলেও জানা গেছে।
‘আর’ হোল্ডিং নামে আশির দশকে সেটেলার বাঙালিদের দেওয়া বন্দোবস্তির ক্ষেত্রেও সেটেলার বাঙালিরা ইচ্ছামতো জায়গা-জমি দখল করে থাকে। ‘আর’ হোল্ডিং হলো তথাকথিত ‘রিফিউজি’দের দেওয়া বন্দোবস্ত কবুলিয়ত, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি লঙ্ঘন করে দেওয়া হয়েছে। এই ‘আর’ হোল্ডিং জমির চৌহদ্দি বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই। যার ফলে ‘আর’ কবুলিয়তধারী সেটেলাররা ইচ্ছামতো জমি বাছাই করে নিজের বলে দাবি করে এবং প্রশাসনের সহায়তায় পাহাড়িদের তাদের বাস্তুভিটা ও বাগান-বাগিচা থেকে উচ্ছেদ করে জমি জবরদখল করে।
সত্যিই তাঁদের সুবিচার পাওয়ার কোনো জায়গা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের দ্বারস্থ হয়েছেন অনেকে। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদের কথা কে শোনে? পার্বত্য জেলা পরিষদ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব ও উদাসীন। তাদের কাছে দরখাস্ত দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এসব মনোনীত পার্বত্য জেলা পরিষদের সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। স্থানীয় সাংসদের কাছে গেলেও অনেক সময় উদাসীনতাই মেলে। আর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন তো বরাবরই সেটেলারদের পক্ষে। অধিকন্তু অনেক আমলা নিজের আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে শত শত একর জমি দখল করেছেন।
দু-একজন পাহাড়ি মামলারও আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পাহাড়িদের অভিযোগ, বিচারব্যবস্থা নিরপেক্ষ নয়। অথবা স্থানীয় আদালতে পাহাড়িরা জিতলেও সেটেলার বাঙালিরা আবার উচ্চ আদালতে যান, যেখানে পাহাড়িদের মামলা পরিচালনা করা সাধ্যের বাইরে। আর অধিকাংশ পাহাড়ি, যাঁদের দুবেলা দুমুঠো ভাতের সংস্থান করতে বা লজ্জা নিবারণের ন্যূনতম কাপড় জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়, তাঁদের পক্ষে আইন-আদালতের আশ্রয় নেওয়া বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার মতো অবস্থা।
এ এলাকার জনগণ শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া। কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে, তারা জানে না। তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন নয় বললেই চলে। নিজেদের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলাও এক কঠিন ব্যাপার। অধিকন্তু বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও আলীকদম উপজেলা সেটেলার অধ্যুষিত হওয়ায় এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের লাগোয়া বিধায় জোরালো প্রতিবাদ করাও ভৌগোলিকভাবে প্রতিকূল। এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় বা অন্য উপজেলায় বা জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রতিদিন বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার মধ্য দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। কোনো ঘটনা ঘটলেই এসব এলাকায় সাম্প্রদায়িকতার জিগির তোলা হয়। ফলে ভৌগোলিকভাবে পাহাড়িরা হয়ে পড়ে জিম্মি ও অসহায়। তারা নিতান্তই নিরুপায়।
মঙ্গল কুমার চাকমা : পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.