শ্রদ্ধাঞ্জলি-আপনাকে অভিবাদন, হে বটবৃক্ষ by বিশ্বজিত্ চৌধুরী

আমরা কথায় কথায় বলি, শতবর্ষের প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো...। আক্ষরিক অর্থেই সেই বটবৃক্ষের প্রতীক হয়ে উঠেছেন আপনি। বিনোদ বিহারী চৌধুরী—নামটি উল্লেখমাত্র একজন অপরাজেয় মানুষের চিত্রকল্প ভেসে ওঠে আমাদের সামনে। স্বাধিকার ও মানবমুক্তির সংগ্রামের প্রতিটি পর্বে আপনি বরাভয়।


শোষণমুক্ত সমাজের জন্য আমাদের দীর্ঘ অপেক্ষা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা আপনার হাত ধরেই যেন বাস্তবতার ভিত্তি পায়। আশাবাদী করে তোলে মানুষকে।
মাত্র ষোলো বছর বয়সে তত্কালীন ‘যুগান্তর’ দলে যোগ দিয়ে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন আপনি। এই উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশ শাসকদের শৃঙ্খলে বন্দী। দেশ ও জাতিকে পরাধীনতার এই গ্লানি থেকে মুক্ত করার জন্য মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আপনারা। সেই ১৯৩০ সালে আপনি সবে কলেজছাত্র। ১২ এপ্রিল স্থানীয় কংগ্রেস ভবনে অনুষ্ঠিত গোপন বৈঠকে ইংরেজবিরোধী সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন আপনি। অস্ত্রাগার দখল করে ইউনিয়ন জ্যাকের পতাকা নামিয়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পতাকা উত্তোলন করে মাস্টারদা সূর্যসেনকে রাষ্ট্রপতি করে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের ঘোষণা দেন আপনারা। ব্রিটিশ শাসন চার দিন অকার্যকর হয়ে পড়েছিল চট্টগ্রামে। মাত্র চারটি দিনের সেই স্বাধীনতা কী বিশাল অনুপ্রেরণার উত্স হয়ে উঠেছিল মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে, তা হয়তো আজ উপলব্ধি করাও কঠিন। এই সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছিল এই উপমহাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রেরণার নাম। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘তোমার প্রতিজ্ঞা তাই আমার প্রতিজ্ঞা, চট্টগ্রাম/আমার হূিপণ্ডে আজ তারি লাল স্বাক্ষর দিলাম।’
১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আপনারা। মাত্র ৪৫ জন বিপ্লবী লড়েছিলেন তিন শয়েরও বেশি প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ সেনার বিরুদ্ধে। অসম সেই যুদ্ধে ১২ জন সহযোদ্ধাকে হারিয়েছিলেন আপনারা। আহত হয়েছিলেন আপনিসহ আরও তিনজন। গলায় গুলি বিদ্ধ হয়েছিল আপনার। যে চারজন মুক্তিসংগ্রামীর সংস্পর্শে এসে বিপ্লবের পথে যাত্রা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ঝুলেছিলেন ফাঁসিতে, মধুসূদন দত্ত শহীদ হয়েছিলেন জালালাবাদ পাহাড়ে। হয়তো একটি অসম্পূর্ণ যুদ্ধের নাম ‘জালালাবাদ যুদ্ধ’—
কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই যুদ্ধের স্মৃতি প্রাণিত করেছিল তখনকার লাখো তরুণকে।
এর পর দীর্ঘ ফেরারি জীবন। ১৯৩৩ সালে গ্রেপ্তার হলেন আপনি। পাঁচ বছর ভোগ করেছেন জেলজীবন। কিন্তু এখানেও সেই হার না মানার গল্প। রাজপুতানার দেউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে আইএ এবং ১৯৩৬ সালে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করেছেন আপনি। ১৯৩৮ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গৃহবন্দী করা হয় আপনাকে। এক বছর গৃহবন্দী থাকার সময়ই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ও বিএল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এরপর আরও কয়েকবার কারাভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু সময়, সমাজ ও জীবন যেন কিছুতেই আপনার জীবনীশক্তি কেড়ে নিতে পারেনি। ফিনিক্স পাখির মতো বারবার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে মাথা তুলে আপনি বলেছেন, ‘আমি আছি।’
আপনার এই সংগ্রামের গল্পই আজ আমাদের প্রেরণা। ১০০ বছরের পথপরিক্রমায় এখনো বয়স আপনাকে ভারাক্রান্ত করতে পারেনি। সুদীর্ঘ জীবনে সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোনো দুর্দিনে আপনি ছিলেন সোচ্চার। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রাম, মানবমুক্তির মিছিলে আপনি এক অনমনীয় অপ্রতিরোধ্য পতাকা।
আজ আপনার শততম জন্মদিন। শতবর্ষের একটি বটবৃক্ষ ডালপালা পত্র ও পল্লবে আজ দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে তার ছায়ার বিস্তার। আমাদের কবিবন্ধু ওমর কায়সার লিখেছেন—
‘তুমি তো এক সুদীর্ঘ কবিতা
একশ বছর ধরে রচিত হয়েছো
যার প্রতি সর্গে সর্গে জীবনের ঘনিষ্ঠ উত্থান
প্রতিপর্বে—অতিপর্বে
কুরুক্ষেত্র বিম্বিত হয়েছে
রঙের বিন্যাসে।
আমি শুধু পাঠ করি তোমার বিস্তার।’
সত্যিই আমরা আজ পাঠ করছি আপনার বিস্তার। তাই আপনার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে আজ চট্টগ্রামে ছুটে এসেছেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানী, ড. ভারতী রায়, শামসুজ্জামান খানসহ বরেণ্য ব্যক্তিরা।
আপনাকে অভিবাদন, হে বটবৃক্ষ!

No comments

Powered by Blogger.