ব্রিটেনে অল্টারনেটিভ ভোট : হ্যাঁ, না এবং অভিবাসী ভাবনা by ফারুক যোশী

অল্টারনেটিভ ভোট' (এভি) শব্দ দুটি ব্রিটেনে অপরিচিত না হলেও জনপ্রিয় নয়। একে জনপ্রিয় করে তুলতে এবং ব্রিটেনের ভোটিং পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে অল্টারনেটিভ ভোট প্রয়োজন_এই লক্ষ্য নিয়ে মূলত ব্রিটেনের বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের শরিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিকরা এ পদ্ধতিটি প্রবর্তন করতে চাইছেন ব্রিটেনে।


গত নির্বাচনে এটি একটি ইস্যুও ছিল তাদের এবং কোয়ালিশন সরকার গঠনের এটা একটা অন্যতম শর্তও ছিল। সে জন্যই এক বছর যেতে না যেতেই বর্তমান সরকারকে এ ইস্যুটি জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে হয়েছে। বিটেনের প্রায় প্রতিটি ঘরে এ বার্তাটি ইতিমধ্যে পেঁৗছে গেছে। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে উদ্যোগ তো নিয়েছেই, অন্যদিকে মূলধারার মিডিয়াগুলোতে এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ব্রিটেনে আগামী ৫ মে হবে স্থানীয় (কাউন্সিল) নির্বাচন। এ নির্বাচনেই আরেকটি ভোট দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে ভোটারদের। হ্যাঁ এবং না অর্থাৎ রেফারেন্ডাম হচ্ছে এই এভি পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে।
অল্টারনেটিভ ভোট পদ্ধতি খুব স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা জটিল এবং পদ্ধতিগতভাবে কিছুটা হলেও এক ধরনের লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। যেহেতু এ পদ্ধতিটি ব্রিটেনের জনগণের জন্য নতুন, সেহেতু এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক। কারণ এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন ভোটারের পছন্দের তালিকায় থাকে সব প্রার্থীই। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম_এভাবে একজন ভোটার প্রত্যেক প্রার্থীকেই ভোট প্রদান করতে পারবেন। একজন প্রার্থী যদি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পান, তাহলে তাঁকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করতে পারবে নির্বাচন কমিশন। যদি তা না হয়, তাহলে মোট কাস্টিং ভোটের সর্বশেষ পছন্দের প্রার্থী ভোট গণনা থেকে বাদ পড়বেন এবং এই বাদপড়া প্রার্থীর প্রাপ্ত ব্যালট পেপার থেকে পছন্দের প্রার্থীদের এনে অন্য প্রার্থীদের মধ্যে আবার গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যদি এবারও ৫০ শতাংশের অধিক কোনো প্রার্থী না পান তাহলে এভাবেই চলতে থাকবে। একজন নক-আউট হবেন, ভোট পুনর্বার বণ্টন করা হবে পছন্দের প্রার্থীদের মধ্যে। আর এতে করে দেখা যায়, প্রথম পছন্দের প্রার্থী শেষ রাউন্ডে এসে কোনো কোনো সময়ে হেরে যান এবং দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রার্থী জয়ের তালিকায় এসে যান। যদিও কেউ কেউ এটাকে ব্যাপকসংখ্যক জনগণের আস্থার জায়গা হিসেবে দেখছেন, কিন্তু পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় এ পদ্ধতি মূলত কোনো সুফল নিয়ে আসছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ফিজি, পাপুয়া নিউ গিনি এবং অস্ট্রেলিয়া ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে এ পদ্ধতি চালু নেই। এমনকি ফিজি ইতিমধ্যে এ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পরিকল্পনা নিচ্ছে এবং অস্ট্রেলিয়ার অন্তত ১০ জন মানুষের মধ্যে ছয়জন মনে করে এই পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। এই যখন এভি পদ্ধতির চিত্র, ঠিক তখন ব্রিটেন শুধু ওই রেফারেন্ডামেই অর্থাৎ হ্যাঁ, না ভোটেই খরচ করছে ৯১ মিলিয়ন পাউন্ড; যা ব্রিটেনের এ মন্দা সময়ে কতটুকু যুক্তিসংগত, সে প্রশ্ন রাখতেই পারে মানুষ। কারণ লাখ লাখ মানুষের চাকরিচ্যুতি, ভ্যাট বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে শুধু কোয়ালিশন সরকারের অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের টিকে থাকার প্রয়োজনে ট্যাঙ্পেয়ারদের এ অর্থ খরচ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া এ পদ্ধতি যদি রেফারেন্ডামে পাস হয়েই যায়, তাহলে ১৩০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে হবে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ভোট গণনা যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ। আরো ২৬ মিলিয়ন পাউন্ড সরকারের খরচ করতে হবে নতুন এই পদ্ধতিটি পরিচিত এবং জনপ্রিয় করে তুলতে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই ২৫০ মিলিয়ন অহেতুক খরচ না করলে সরকার এ মন্দায় অন্তত দুই হাজার ৫০৭ জন ডাক্তার, ছয় হাজার ৯৭ জন শিক্ষক, আট হাজার ১০৭ জন নতুন নার্স নিয়োগ দিতে পারবে। করা যাবে ৩৫ হাজার ৮৮৫ জন মানুষের হিপ রিপ্লেসমেন্ট। নির্মাণ করা যাবে ৬৯ হাজার ৮৩২টি স্কুল। আর সে জন্যই এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।
কনজারভেটিভ পার্টি পুরোটাই বলতে গেলে এভি ভোটের বিরুদ্ধে। কনজারভেটিভ পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দা ওয়ারর্সী 'এভি' ভোটের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে গিয়ে বলেছেন, যদি এ পদ্ধতিটি রেফারেন্ডামে পাস হয় এবং ব্রিটেনের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, তাহলে দুঃখজনকভাবে হলেও একসময় দেখা যাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক দল বিএনপির এমপিরা বাসভর্তি হয়ে এসে ওয়েস্টমিনস্টারের চেয়ারে বসবেন এবং খুব স্বাভাবিকভাবে এর ফল হবে ব্রিটেনের জন্য ভয়াবহ। এখন আলোচনায় আসা যেতে পারে ওয়ার্সীর এ উদ্বিগ্নতার কারণটাই বা কী। দেখা গেছে, অনেক জায়গায় প্রধান দলগুলোর সমর্থক কিংবা সাধারণ কর্মী অন্য প্রধান বিরোধী দলকে সমর্থন করে না এবং এই সমর্থন না করায় দুই দলের কর্মী কিংবা সমর্থক তার দ্বিতীয় পছন্দের তালিকায় এমন একজনকে নিয়ে আসবে, যাতে করে ওই প্রার্থী প্রকারান্তরে দুই দলেরই সমর্থন পেয়ে যায়। যেহেতু এখন লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এবং ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি বৃদ্ধি, জনগণের চাকরিহীনতা, ভ্যাট বৃদ্ধি প্রভৃতি ইস্যুসহ সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতিতে সহায়ক, সেখানে দুটি দলেরই একটা বিরাট অঙ্কের কর্মী-সমর্থকের দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে ওই পার্টিটা নাও আসতে পারে এবং এ ভোটগুলো বিএনপির বাঙ্ েপড়া অস্বাভাবিকও নয়। যদিও লিবারেল ডেমোক্রেটিকরা হয়তো আশা করছেন দ্বিতীয় পছন্দের তালিকায় ভোটারদের একটা বড় অংশ তাঁদের ভোট দেবে। কিন্তু ফল যা-ই আসুক না কেন, সৈয়দা ওয়ার্সীর কথাটা ফেলে দেওয়া যায় না। বিশেষত ব্রিটেনের ইমিগ্রেশন ইস্যু নিয়ে যেহেতু বর্তমানে জনগণের মধ্যে একটা বিরূপ মনোভাব কাজ করছে, আর সেহেতু বিএনপি যে এই ভোট পদ্ধতির সুফল তাদের ঘরে তুলতে চাইবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। লিবারেল ডেমোক্র্যাট মনে করছে অল্টারনেটিভ ভোট পদ্ধতি চালু হলে তাদের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সত্যি কথা বলতে গিয়ে রাজনৈতিক এই গেইন কিংবা সুযোগটুকুর জন্যই নিক ক্লেগ কিংবা তাঁর দলের এই পদক্ষেপ। সে জন্য তাদের জোর প্রচারণাও চলছে। যেমন ডেভিড ক্যামেরন সর্বশক্তি দিয়ে না-র জন্যই ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন।
এভি পদ্ধতির রেফারেন্ডামের ব্যাপারটা জনগণের মধ্যে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে, তা কিন্তু এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ। ব্রিটেনের ঘরে ঘরে এভি পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে কাগজপত্র আসছে। কিন্তু এর পরও বাঙালি কমিউনিটির অনেকের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেছে কেউ যেন খুব গা করছেন না। অনেকেই আবার এ পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখেন না। ভোটের দিন হ্যাঁ কিংবা না_কোথায় ভোট দেবেন_এ প্রশ্ন করে অনেকের কাছেই কোনো স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ৫ মে ব্রিটেনের অন্যান্য জায়গায় স্থানীয় নির্বাচন হলেও গ্রেটার লন্ডনে কাউন্সিল নির্বাচন হচ্ছে না। সে কারণে লন্ডনে শুধু হ্যাঁ কিংবা না ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের কত শতাংশ উপস্থিত থাকবেন, তা নিয়েও সংশয় আছে। অথচ ব্রিটেনের সাংবিধানিক পরিবর্তনে এ ভোট রাখবে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সে হিসেবে ব্রিটেনের এই হ্যাঁ-না ভোট নিঃসন্দেহে জনগণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভোট। এই ভোট ব্রিটেনের ইতিহাসে আনবে এক নতুন ধারা। এভির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ রায় দিলে ব্রিটেনের সংবিধানে সংযোজিত হবে এক যুগান্তকারী অধ্যায়_এক নতুন ধারা। এই ধারার মধ্য দিয়ে আগামীর রাজনীতিতেও হয়ে যেতে পারে নতুন মেরুকরণ। গণতন্ত্রকে আরো জনমুখী করতে গিয়ে রাজনীতিতে একটা আনফেয়ার পদ্ধতিই কি ভর করবে_এ প্রশ্নটাই হয়তো উঠে আসবে আগামীর ব্রিটেনে। কারণ এই পদ্ধতির কারণে যেসব শঙ্কা বেরিয়ে আসছে, তা একদম শতভাগ প্রতিফলিত না হলেও শঙ্কাগুলোর অনেক কিছুই বাস্তব হয়ে চেপে বসবে জনগণের ওপর। সে জন্য বিশেষত বাঙালি কমিউনিটিসহ এশিয়ান কিংবা অভিবাসী কমিউনিটিদের এ ব্যাপারটি অবশ্যই বিশেষ ভাবনায় নিতে হবে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক
faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.