হত্যা, গুম এবং বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড by ডা. এম এ হাসান

অপরাধের যখন বিচার হয় না, তখন সে অপরাধ সমাজে বৈধতা পায়। আর তখনই অপরাধীর চরিত্র শুষে নেয় সমাজ। এতে অপরাধীর নষ্ট দর্শন যেমন নানাভাবে চর্চিত হয়, তেমনি সমাজের নানা অঙ্গে নানা ভঙ্গিতে এসব অপরাধ বিকশিত হয়। সব অপরাধের পেছনে থাকে একটি ভারসাম্যহীন মাইন্ডসেট, অসহিষ্ণুতা এবং মানবিক মূল্যবোধের


অভাব। এর মধ্যে ক্রোধ, লোভ এবং জিঘাংসা অন্যতম। এই আলোকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত নানা অপরাধের মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ এবং গুমের বিষয়গুলোকে পর্যালোচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, কিছু কিছু অপরাধ রয়েছে, যা নিতান্ত বিচ্ছিন্ন এবং ব্যক্তিগত। আর কিছু রয়েছে সমষ্টিগত তথা অরগানাইজড। ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি, কিভাবে একটি সুশিক্ষিত বাহিনী এবং তাদের দোসররা সমষ্টিগতভাবে তথা অরগানাইজডভাবে পৈশাচিক হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনে লিপ্ত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাধগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি দেখেছি, কিভাবে ময়মনসিংহ, নরসিংদী, ভৈরব এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হত্যা, লুণ্ঠন এবং নির্যাতন হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে এবং মানবতার দৃষ্টিতে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাই বৈধ নয়। স্বাধীনতার পরও আমি ষোড়শ ডিভিশনসহ মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার এবং তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক লুণ্ঠন এবং হত্যাযজ্ঞ দেখেছি। যুদ্ধের শুরুতে ভৈরবে যেমন নিরীহ নারী নির্যাতনের কথা জেনেছি, তেমনি যুদ্ধের ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাকাউন্টস জেনারেল মিস সেলিনার ভগ্নিকে ধর্ষিত হতে দেখেছি। এসবের কোনো বিচার হয়নি। আমি, শহীদ লে. সেলিম ও তখনকার ক্যাপ্টেন মতিন এ বিষয় প্রতিবাদ করে কোনো প্রতিকার পাইনি। উল্টো স্বাধীনতার পর পরই আমাদের নিজেদের লোকেরাই আমার ভাইকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন মিরপুরে হত্যা করেছে। রাষ্ট্র তাঁর খোঁজ নেয়নি এবং কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা করেনি। বরং প্রহসনমূলকভাবে কয়েক টুকরো অজানা হাড় পরিবারের কাছে গছিয়ে দিয়ে আরো প্রহসনমূলকভাবে তাঁর শেষকৃত্য সম্পাদন করে। এ সময় বিচারপতি আবু সাঈদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমাকে এবং আমার বাবাকে তাঁর অসহায়ত্বের কথা ব্যক্ত করেন। এর প্রতিবাদ করায় কেবল আমার ও আমার ভাইয়ের খেতাবই কেড়ে নেওয়া হয়নি; বরং ব্যক্তিগতভাবে আমাকে সব রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। উপরন্তু আমাকে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। এর পরও আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শ থেকে এতটুকু বিচ্যুত হইনি। আমার বাবা সব কিছু হারিয়েও কারো কাছে মাথা নত করেননি।
এই শিবের গাজনটি ব্যক্ত করার কারণ হলো ভণ্ড তপস্বীদের মুখোশ উন্মোচন এবং তথাকথিত গণতন্ত্রের ঝাণ্ডাধারী তথা বীরপুঙ্গবদের সুবর্ণোজ্জ্বল চরিত্র সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা দেওয়া। সেই সঙ্গে শেকড়ে বাঁধা অপরাধের বীজ ও জীবাণুর কথা ব্যক্ত করা। অসহিষ্ণুতা এবং অবাঞ্ছিত অহংবোধ আমাদের রক্তে, চরিত্রগতভাবে আমরা ক্ষণে পর্বত এবং ক্ষণে মূষিক। আজ যদি জাতিগতভাবে হই মহীরুহ আগামীকাল হব তৃণসম। তোষামোদ আর মিথ্যাচার তো রক্তে মিশে আছে। এ কারণে শর্ষের মধ্যে সর্বদাই ভূত থেকে যায়। আর নিরস্ত্র ও দুর্বলের কাছে আমরা অনেকেই ব্যাঘ্রসম। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর যাঁরা রেসকোর্স ময়দানে হাত-পা বাঁধা নিরস্ত্র রাজাকারদের খুঁচিয়ে মারতে দেখেছেন তাঁরা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন। এমন এক বীরপুঙ্গব আরটিভিতে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তাঁর উচ্চতা পরিমাপ করার জন্য পরামর্শ দিয়ে জানান যে তিনি না থাকলে দেশের স্বাধীনতা তিন বছরের জন্য পিছিয়ে যেত। এই হলো মেগালোম্যানিক নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি- সাধারণের ত্যাগ ও অর্জনের প্রতি সম্মানবোধ। অন্তরে অন্তরে যখন অপরকে কীটস্যকীট হিসেবে গণনা করা হয়, তখন তাকে সরিয়ে দিতে, মাড়িয়ে দিতে অসুবিধা কোথায় এবং যখনই স্বার্থে আঘাত লাগছে, তখনই আপন ক্ষমতাবলে এরা তাই করছে। কেউ ইউনিফর্ম পরে, কেউ সাদা পোশাকে। কেউ রাষ্ট্র দ্বারা আদিষ্ট হয়ে, আর কেউ স্বপ্রণোদনায়। অপরাধ করছে কেউ লোভে, কেউ জিঘাংসায়। এসব অপ্রিয় কথা গুন্টার গ্রাসের মতো বলতে হচ্ছে- সময় দ্রুত পার হচ্ছে, হয়তো পরে বলার সময় হবে না। আর কাউকে কাউকে সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবন উৎসর্গ করতেই হবে। আশা করব, ব্যক্তি ও জাতির চরিত্রে ইতিবাচক উত্তরণ ঘটবে দ্রুত।
আপাতত সাগর-রুনি, মেজর রোকন, ইলিয়াস আলী, ঢাকার আগারগাঁওয়ের নুরু হাজি ও তাঁর জামাতা মান্নানের কথা আলোচনা করা যাক। গত ছয় মাসের মধ্যে নুরু হাজি ও তাঁর জামাতা মান্নান একজনের পর একজন উধাও হয়ে গেলেন আগারগাঁও থেকে। মান্নানের স্ত্রী স্বপ্না আমার রোগী। সেই সূত্রে আমার এসব জানা। লোকমুখে শুনেছি, নুরু হাজি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে কারণে প্রতিপক্ষ বা সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা তিনি অপহৃত হন এবং তারপর যথারীতি গুম হয়ে যান। এসব নিয়ে যখন জামাতা মান্নান দৌড়ঝাঁপ করছিলেন, তখন দুই মাস পরে তিনিও গুম হয়ে যান। এদের দুজনের কেউ আজও ফেরেননি। সিলেটের মেজর রোকনের কাহিনীটি কয়েক দিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মেজর রোকন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে আমার সহপাঠী ছিল। সেই হিসেবে তার প্রতি আমার সহমর্মিতা থাকাই স্বাভাবিক। ২০০২ সালে 'যুদ্ধ ও নারী' শীর্ষক নামে একটি বই লেখার জন্য তৎকালীন সরকার যখন এনএসআই কর্মকর্তা কর্নেল ওয়াসিম মারফত আমাকে বন্দি করার চেষ্টা করে তখন মেজর রোকন আমাকে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সে জানিয়েছিল, খালেদা জিয়ার ভাই মেজর এস্কান্দার তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যাহোক, সেবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর হস্তক্ষেপে আমি বন্দি হওয়া থেকে রক্ষা পাই। মেজর রোকন জানত না সে কোন দেশে বসবাস করছে। ২০০৩ সালে সে জমিসংক্রান্ত একটি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মেজর ইস্কান্দারের সঙ্গে দেখা করার পর পরই বিশ্বভুবন থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় বলে জানতে পারি পত্রিকায়। জানতে পারি, সিলেটের অনেকেই এমনভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। যেমনটা চট্টগ্রামের জামালউদ্দিন অদৃশ্য হয়েছেন নিজ দলের ব্যক্তি দ্বারা। আজ যারা ইলিয়াস প্রসঙ্গে জনগণকে সীমাহীন কষ্ট ও হরতাল যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে তাদের এবং বিবেকবান রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে, প্রতিটি গুমের জন্য যদি তিন দিন হরতাল করা যায়, তাহলে বার্ষিক গুমের প্রতিবাদ করতে হলে অন্ততপক্ষে বছরে ৩০০ দিন হরতাল করতে হবে।
Enforced Disappearance বা Involuntary Disappearance-এর বিষয়টি ব্যক্তিগত এবং দলগতভাবে না দেখে জাতীয়ভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। নিখোঁজ ব্যক্তির হদিস বের করার ক্ষেত্রে যেমন সব নিখোঁজ পরিবার সদস্যদের সমষ্টিগত প্রয়াস প্রয়োজন, তেমনি আইনের শাসন এবং মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সৎ, একনিষ্ঠ ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের অধিকার সম্পর্কে যেমন সচেতন থাকা প্রয়োজন, তেমনি এসব বিষয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সাধারণ নাগরিকের বোধে আনা প্রয়োজন। কেবল ব্যক্তিস্বার্থে ন্যায় কথা বললে হবে না, সাধারণ জনগণের জীবনের মূল্য ও মর্যাদার কথা মনে রেখে তাদের কীটতুল্য বা তুচ্ছ না মনে করে সবার নাগরিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন করতে হবে। লুটেরা শক্তি ও অপশক্তিকে নিজ দল, গোষ্ঠী ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। অপরাধ ও দুর্নীতিকে কঠোরভাবে না বলতে পারলে মায়াকান্না দেখিয়ে লাভ নেই। দিন আসছে, মানুষ ভণ্ড তপস্বীদের জ্যান্ত কবর দেবে। আমি সাধারণের সেই অসাধারণ জাগরণের অপেক্ষায় রয়েছি। প্রসঙ্গক্রমে সাগর ও রুনির ব্যাপারটা আসে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে এই সাংবাদিক দম্পতিকে জীবন দিতে হলো, নাকি সাপের সঙ্গে সহবাস করতে গিয়ে অপঘাত হলো, সেটা ভাবার বিষয়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, অপরাধী যে-ই হোক না কেন, সে সাগর ও রুনির বিশেষ করে রুনির পরিচিত ছিল। শিশু মেঘ যাদের চিনতে পেরেছে, তাদের জনগণ ক্যামেরার সামনে দেখতে চায়। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত পরিপূর্ণ ফরেনসিক পরীক্ষাটা কেন হলো না, শুরুতে অবশ্যকরণীয় ভিসেরা টেস্ট, রক্তের বায়োকেমিক্যাল টেস্ট, ডিএনএ, ফিঙ্গার প্রিন্টসহ অন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো কেন হলো না- সেটা একটা জিজ্ঞাসা থেকে যায়। 'বাঁচবার আশা নেই, বাঁচাবার ভাষা নেই', জেনেও ক্ষণে আশা জাগে- আজ হোক, কাল হোক, ব্যক্তি ও সমষ্টির পাপ সমুদ্রের অতল থেকে জেগে উঠবে।

লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও আহ্বায়ক, ওয়ারক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি

No comments

Powered by Blogger.