দেখে এসে লেখা-‘ম্যাডাম হুকুম দিলে রাজপথ ছাড়ব না’ by মশিউল আলম

বেলা দেড়টায় সোনারগাঁও হোটেলের পাশের চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে দাঁড়িয়ে বাঁয়ে ও ডানে তাকালে দেখা যায়, ফার্মগেট থেকে বাংলামোটরের দিকে যত দূর চোখ যায় কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ অস্বাভাবিক রকম জনবিরল। নগরের মধ্যে যেসব বাস চলাচল করে সেগুলোর একটিও নেই,


প্রাইভেট কার নেই; মাঝেমধ্যে দু-একটা জিপ বা স্টেশন ওয়াগন-জাতীয় মোটরযান দেখা যায়, আর দেখা যায় সবুজ কচ্ছপের মতো সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মনুষ্যচালিত ত্রিচক্রযান রিকশা। ফুটপাতে পায়েচলা মানুষের সংখ্যাও বেশ কম। মনে হয় যেন কী এক অনিশ্চিত, অনির্দিষ্ট শঙ্কায় ঢাকা মহানগরের মানুষ আজ ঘরের বাইরে আসেনি। সড়কের দুই পাশের দোকানপাটের ঝাপগুলো খোলেনি, অফিস-আদালত চলছে কি না বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
যে সড়কে অন্যান্য দিন রিকশা চলে না, সেই কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ দিয়ে রিকশায় শাহবাগের দিকে যেতে যেতে দেখি বাংলামোটর মোড়ও একই রকম জনবিরল; মগবাজার হয়ে মৌচাক-মালিবাগের দিকে চলে গেছে যে রাস্তাটি, তার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দৌড়ে যাচ্ছে শেষ ফাল্গুনের দুপুরের রোদ।
দুই পাশে দুই হাসপাতাল নিয়ে যানবাহন আর মানুষে ভরপুর হয়ে টগবগ করে ফোটে যে শাহবাগ মোড়, রূপসী বাংলা হোটেলের (শেরাটন) কাছে বাঁ দিকে ঘোরার আগে সেদিকে তাকালে দেখতে পাই, ওদিকে যেন আজ কারও কোনো কাজ নেই।
নির্জনতা ও নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ডান পাশে রমনা উদ্যান আর বাঁয়ে মন্ত্রিপাড়া পেরিয়ে কাকরাইল মসজিদের কাছে পৌঁছুলে দৃশ্যপট বদলে যায় হঠাৎ। কাকরাইলের দিকে চলে গেছে যে সড়ক, তা ভরে গেছে মানুষে। যানবাহন নেই, শুধুই মানুষ। সামান্য কিছু রিকশা ও অটোরিকশাযাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে মোড় থেকে চলে যাচ্ছে, বা নতুন যাত্রীর আশায় খানিক দাঁড়িয়ে থাকছে। রাস্তার দুধারে ঝালমুড়ি, চানাচুর, আলুভাজি, পান-সিগারেট, ডাব, মিনারেল ওয়াটার ইত্যাদির পসরা; তাদের কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ। দূর দূর থেকে মিছিলের শব্দ ভেসে আসে, বাঁ পাশ দিয়েই ছোট একটা মিছিল চলে যায় নয়াপল্টনের দিকে। ব্যানার-ফেস্টুন, কর্মীদের পরনে গেঞ্জি ও মাথায় লাল-সবুজ টুপিতে খচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, যুবদল বা ছাত্রদল; সেই সঙ্গে আঞ্চলিক শাখার নাম। চৌরাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জটলা, তাদের চোখমুখ, দাঁড়ানোর ভঙ্গি খেয়াল করে দেখলে মনে হয় না বিশেষ কোনো সতর্কতা আছে। কাছে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি। ‘শান্তিপূর্ণ?’ ‘আমরা তো কোনো সমস্যা দেখি না।’
রাজমণি সিনেমা হলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি, সেজন্য ভিড় ঠেলতে হয় না, ভিড় খুব ঘন নয়। হোটেল ঈসা খাঁ রাজমণির বারান্দার ছায়ায় বসে আলুভাজি খাচ্ছেন কিছু কর্মী। ‘যুবদল, যশোর জেলা শাখা’ লেখা টুপি পরা এক তরুণকে জিজ্ঞেস করি, ‘যশোর থেকে এসেছেন কীভাবে?’ তরুণ জানালেন, তিনি আজ সকালে বিমানে এসেছেন, তবে অন্যরা এসেছেন নানা উপায়ে, ভেঙে ভেঙে। কখনো বাস, কখনো নছিমন-করিমন, কখনো রিকশা, কখনো হেঁটে। খুলনা থেকে আসা একজন বললেন, তাঁরাও এসেছেন বিচ্ছিন্নভাবে, ট্রেনসহ নানা পথে, একই রকম ভেঙে ভেঙে।
বেলা দুইটা ১৬ মিনিটে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে একটি গাড়ি যখন কাকরাইল মোড়ে পৌঁছায়, তখন মাইকে একটি কণ্ঠ তারস্বরে ঘোষণা করছিল: ‘হাসিনার হুকুমে এখন আর দেশ চলছে না। দেশ এখন চলছে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে...।’ দুই পাশে সারি ধরে দাঁড়ানো কর্মীদের স্লোগান আর মাইকের উচ্চকিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে খালেদা জিয়ার গাড়ি। কাকরাইল মোড় থেকে নয়াপল্টনের দিকে যত এগিয়ে যাই, ততই ভিড় বাড়তে থাকে। রাস্তার এক পাশে ইতিমধ্যে বসে পড়েছেন অনেকে; দূরে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তৈরি মঞ্চে জনসভা শুরু হয়ে গেছে।
কাকরাইল মোড় থেকে গুলিস্তানের দিকের রাস্তা ধরে এগোলে ভিড় ক্রমশ কমে আসতে থাকে। রিকশা ও অটোরিকশার দেখা মিলতে শুরু করে। এক জায়গায় দেখা যায় ‘সম্মিলিত পেশাজীবী ফোরাম’ ও ‘সচেতন প্রকৌশলী সমাজ’ নামের দুটি সংগঠনের দুটি ব্যানার। একটিতে নিজামী, সাঈদী, সাকা চৌধুরীদের মুক্তির দাবি করা হয়েছে, আরেকটিতে সরকারের পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। পুরানা পল্টনের মোড়ে পৌঁছুলে আবারও ফিরে আসে সেই নির্জন ভাব ও প্রায়নৈঃশব্দ্য। গুলিস্তানের দিকে তাকালেও দেখা যায়, রাস্তা জনবিরল, যানবাহন নেই বললেই চলে। এক কোণে টহলরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চেহারাগুলো নিরুদ্বেগ। বাঁয়ে ঘুরে হেঁটে দৈনিক বাংলার মোড়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ করি, বায়তুল মোকাররমের দিকটা যেন আরও বিরান। দৈনিক বাংলার মোড় থেকে সোজা সামনের দিকে মতিঝিল ও ডানে স্টেডিয়ামের ওদিকের রাস্তাটিরও একই রকম জনবিরল চেহারা। মনে হলো, যানজটে মন্থর কিন্তু অস্থির মানুষের কোলাহলে পূর্ণ মহানগর ঢাকায় আজ এ কী সুনসান নীরবতা! কিন্তু আজ কোনো হরতালের দিন নয়।
ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যায়, তারপর থেকে ভিড় বাড়তে থাকে, যেমনটি দেখা গেছে কাকরাইলের ওদিকে নয়াপল্টনের রাস্তায়। সরকার নির্দেশ দিয়েছে, চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এই জায়গার মধ্যেই। জোটের প্রধান দল বিএনপি ও শরিক দলগুলো কি সরকারের সেই নির্দেশ মেনেই মহাসমাবেশ আর বাড়তে দেয়নি?
বিষয়টা মোটেও সে রকম নয়। এ কথা বললেন চাঁদপুর থেকে আসা কয়েকজন যুবদল নেতা-কর্মী: ‘সরকার তো সব রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে দেখলে পুলিশ ধরে দেহতল্লাশি করেছে, জিজ্ঞাসা করেছে আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। চাঁদপুরে দীপু মনি একরকম কারফিউ জারি করেছে।’ জানতে চাইলাম, তাহলে তাঁরা ঢাকা পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন কী উপায়ে। উত্তর: ট্রলারে, ট্যাক্সিতে, অটোরিকশায়, পায়ে হেঁটে। একজন বললেন, পথে পুলিশ তাঁদের ট্যাক্সি আটকালে তাঁরা একজনের পাসপোর্ট দেখিয়ে বলেছেন, ‘বিদেশে যাব, বিমানবন্দরে যাচ্ছি।’ তাঁদের দাবি, এত বাধাবিপত্তির পরও চাঁদপুর থেকে হাজার পাঁচেক মানুষ ঢাকা এসেছেন মহাসমাবেশে যোগ দিতে। সরকার সব পথ বন্ধ না করে দিলে এই সংখ্যা হতো লাখের কাছাকাছি। বগুড়া থেকে আসা যুবদলের কর্মীও বললেন একই কথা। লক্ষ্মীপুর থেকে তিন দিন আগে এসেছেন আবদুল মান্নান, দুই দিন ধরে হোটেলে ওঠার করে ব্যর্থ হয়ে বন্ধুর বাসায় ঠাঁই নিয়েছেন; গোসল করেননি তিন দিন।
এত কষ্ট করে মহাসমাবেশে এসেছেন, কী চান? এই প্রশ্ন করেছি বগুড়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, মুন্সিগঞ্জ, পটুয়াখালী, গাজীপুর থেকে আসা তরুণ-যুবকদের। লক্ষ্মীপুরের আবদুল মান্নান বললেন, ‘এই সরকারের পদত্যাগ চাই, আজকেই, এক্ষুনি।’ কিন্তু সরকার যে পদত্যাগ করবে, এমন কোনো লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না—আমার এই মন্তব্যের জবাবে মান্নান বলেন, ‘আমরা তো আসছি ম্যাডামের নির্দেশ শুনতে। ম্যাডাম যদি আজ বলে, এই জুলুমবাজ সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না, তাহলে আমরা এখান থেকে আর যাব না।’ মান্নানের পাশে বসা পুরান ঢাকার কাপড় ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন মান্নানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘ম্যাডামকে আমরা বলব, আপনি ভাষণ দিয়ে বাসায় চলে যান, আমরা রাজপথে থাকলাম। সরকারকে বিদায় না করে ঘরে ফিরে যাব না।’ গাজীপুর থেকে আসা তরুণেরা বললেন, ‘আমরা খাবার-দাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছি। ম্যাডাম হুকুম দিলে রাজপথ আর ছাড়ব না।’ পটুয়াখালীর যুবদলের এক কর্মী বললেন, ‘আমরা চাই, ম্যাডাম এই ঘোষণা দিন, আমরা রাজপথ ছাড়ব না।’
বিকেল সাড়ে চারটা, তখনো খালেদা জিয়ার ভাষণ শুরু হয়নি। তিনি কী ঘোষণা দেবেন, তা নিয়ে কর্মীদের মধ্যে জল্পনাকল্পনা। একজন অবশ্য বললেন, ‘খালেদা জিয়া রাজপথ না ছাড়ার হুকুম দিতে পারেন, আবার নাও দিতে পারেন। তবে হরতাল যে দেবেন, এটা নিশ্চিত। কিন্তু আমরা চাই, তিনি যেন আমাদের রাজপথ না ছাড়ার নির্দেশ দেন।’
বিএনপির কর্মীরা কি তবে ঢাকায় ‘আরব বসন্ত’ আনার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন? সরকারি দলের কোনো কোনো নেতার মুখে যে আশঙ্কার কথা শোনা গেছে, তা কি ভিত্তিহীন নয়?
১২ মার্চ ২০১২
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.