বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস-জনঘনত্ব ও খাদ্যনিরাপত্তা by জিয়া উদ্দিন আহমেদ

আমাদের অত্যুচ্চ জনঘনত্ব ধরিত্রীর ইতিহাসে কেবল এক নজিরবিহীন ঘটনাই নয়, জীবতাত্ত্বিক বিস্ময়ও। বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে জনঘনত্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম, জনসংখ্যায় সপ্তম এবং আয়তনে চুরানব্বইতম। কৃষিকাজে নিয়োজিত মোট জনগোষ্ঠীর আকার হিসেবে মাথাপিছু জমির পরিমাণ আমাদের অতি নগণ্য—০.১ হেক্টর, যা বিশ্বের সর্বনিম্ন।

তবে দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ হিসেবে বিশ্বে আমাদের স্থান ৩৪তম। দেশের বেশির ভাগ এলাকা বিস্তীর্ণ বদ্বীপের অংশ এবং প্রাকৃতিকভাবে উর্বর আর নিবিড় চাষযোগ্য। দিনে দিনে আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে। কমছে চাষের জমি। বাঁচার প্রয়োজনে চাই রাস্তাঘাট, হাটবাজার, বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, ক্লিনিক-হাসপাতাল, কলকারখানা ইত্যাদি। এসব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য পর্যাপ্ত পতিত জমি আমাদের নেই, সবকিছুই গড়ে উঠবে কৃষিজমি উদরস্থ করে।
নতুন জমি সৃষ্টির পথও আমাদের সীমিত। কিছু পরিমাণ জমি হাওর-বিল ভরাট হয়ে তৈরি হচ্ছে আর সামান্য পরিমাণ উপকূলীয় জমি ধীরে ধীরে আবাদযোগ্য করা যাবে সীমিত ফসলাদির জন্য। দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ও জমিতে ফলনের হিসাব নিয়ে তথ্য অপ্রতুল, অনেক ক্ষেত্রে তথ্যের উপস্থাপনাও সহজবোধ্য হয় না। জাতিসংঘের (UNDP/FAO) ১৯৮৮ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ১.৩৮ কোটি হেক্টর বলা হয়েছে, যা থেকে খাদ্যশস্য উৎ পাদনে ব্যবহূত জমির পরিমাণ প্রায় এক কোটি হেক্টর—অভ্যন্তরীণ ৭০ লাখ এবং উপকূলীয় আবাদযোগ্য ৩০ লাখ হেক্টর। এই তথ্য নিট জমির সূত্ররেখা হিসেবে ধরে ভবিষ্যতে জমির পরিমাণ এবং খাদ্যশস্য উৎ পাদনের মাত্রা সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। ২০০৮ সালের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৭৭ লাখ হেক্টর আর নিট ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে বাৎ সরিক গড়ে দুটি ধান চাষ করে হেক্টরপ্রতি উৎ পাদন ২.৮ টন হিসাবে মোট চাল উৎ পাদন হয় বাৎ সরিক ২.৯ কোটি টন। ২০০০ সালে দেশে নিট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৮০ লাখ হেক্টর, ২০০৮ সালে ৭৬ লাখ হেক্টর—অর্থাৎ ০.৫ লাখ হেক্টর নিট আবাদি জমি (বছরে জমিতে গড়ে দুটি ফসল করা হলে এক লাখ হেক্টর আবাদকৃত জমি) প্রতিবছর আবাদকক্ষ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে অতিঘন জনবসতির নিবিড় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের চাপের ফল।
ফলে ২০৫০ সালের চিত্রটি হবে ভিন্ন। তখন দেশে জনসংখ্যা হবে ৩০ কোটি এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রয়োজনে আমাদের বছরে প্রায় ৫.৩ কোটি টন চাল উৎ পাদন করতে হবে। তখন সর্বোচ্চ নিট ৩০ লাখ হেক্টর জমি ধান চাষের জন্য পাওয়া যেতে পারে। সেখানে বছরে দুটি ফসলের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি ৮.৫ টন খাদ্যশস্য উৎ পাদন সম্ভব হলে মোট বাৎ সরিক উৎ পাদন হবে ৫.১ কোটি টন। আর জনসংখ্যা ২০৫০ সালে ২৫ কোটিতে স্থিতিশীল হলে এবং একই পরিমাণ জমি ধান চাষের জন্য পাওয়া গেলে আমাদের প্রয়োজন হবে ৪.৪ কোটি টন খাদ্যশস্য এবং উৎ পাদন হতে হবে হেক্টরপ্রতি বছরে সাত টন। বর্তমানে বোরো, আমন, আউশ—এসব জাতের ধান দেশের বিভিন্ন ইকোসিস্টেমে বিভিন্ন পদ্ধতিতে চাষ করে গড় বার্ষিক চাল উৎ পাদন হচ্ছে হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ৩.৫ টন। এই মাত্রা থেকে আমাদের হেক্টরপ্রতি বছরে ৮.৫ টনে পৌঁছাতে হবে। কারিগরি দিক থেকে এটি অসম্ভব না হলেও এটি অর্জনের জন্য নানা বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বর্তমানে চালের গড় উৎ পাদন টন হিসাবে হেক্টরপ্রতি থাইল্যান্ডে ৩.০, শ্রীলঙ্কা ৪.০, ভারত ৪.০। এ প্রসঙ্গে আমাদের অতিঘন জনবসতির জানা-অজানা নানাবিধ জৈবিক চাপের কথাও খাদ্য উৎ পাদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনায় রাখতে হবে।
আমাদের দেশে কৃষি হচ্ছে বেঁচে থাকার একটি বিশেষ ক্ষেত্র। জমির তীব্র সংকটের কারণে কৃষি আমাদের বাজারভিত্তিক বাণিজ্যিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে আমরা উৎ পাদনের মাত্রাজনিত সুবিধা থেকে সর্বদা বঞ্চিত এবং এ কারণেই কৃষিক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। আমাদের জনসংখ্যা কবে কোন মাত্রায় স্থিতিশীল হবে, তখন আবাদি জমির পরিমাণ কী থাকবে, একরপ্রতি খাদ্যশস্যের ফলন বৃদ্ধি কী পরিমাণ সম্ভব হবে—এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য আবশ্যক। বর্তমানে অধিক অর্থকরী ফসলে জমি পুনর্বণ্টন হচ্ছে, ধানচাষকক্ষ থেকে অনেক জমি অধিক মূল্যসংযোজিত ফসলের আবাদে হারিয়ে যাচ্ছে। মূল খাদ্য উৎ পাদনের জন্য সর্বোচ্চ কারিগরি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের ৭৫ শতাংশ জমি ব্যবহূত হলে ফসল বহুমুখীকরণের স্বরূপ কেমন হবে, তা-ও একটি ভাবনার বিষয়।
আমাদের খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য যে পরিমাণ জমি প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করে ‘আবদ্ধীকরণ’ সম্ভব কি না, সেই বিষয়টিও বিবেচ্য বটে। জমি আবদ্ধীকরণ দুইভাবে হতে পারে—ফসলের উচ্চমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে কৃষক ধান উৎ পাদনে উৎ সাহিত হবেন। আর আইন করেও তা করা যেতে পারে, তবে সেখানেও দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ—কৃষকের স্বার্থরক্ষা এবং দরিদ্র মানুষের চাল পাওয়ার নিশ্চয়তা। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ভর্তুকির ব্যবস্থাও রাখতে হতে পারে।
ফসল বহুমুখীকরণও উপেক্ষার বিষয় নয়, তবে তা আবদ্ধিকৃত জমির বাইরে হতে হবে। খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রয়োজনে ধানি জমির পরিমাণ ২০৫০ সাল নাগাদ অবশ্যই নিট ৩০ লাখ হেক্টরে টিকিয়ে রাখতে হবে। নতুন জমি সৃষ্টির সম্ভাবনার কথাও চিন্তা করতে হবে। জনসংখ্যার প্রচণ্ড চাপের কারণে প্রচুর রাস্তাঘাট তৈরি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে। সীমিত ভূমিতে ঘন জনবসতির পরিস্থিতিতে রাস্তাঘাট নির্মাণের পরিকল্পনায় নানা সীমাবদ্ধতা থাকবে। নদীভাঙন নিয়ন্ত্রণে রেখে যদি এভাবে কিছু কৃষিজমি সৃষ্টি সম্ভব হয়, তবে তা আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে। এ ছাড়া দেশে প্রায় তিন লাখ হেক্টর সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা রয়েছে, যা উপযুক্ত জাতের ফসল উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষি উপযোগী করে তোলা সম্ভব।
আর্থিক উন্নতির সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও কিছু পরিবর্তন আসবে এবং মাথাপিছু চালের প্রয়োজন কমে যাবে। পরিবর্তে মাংস, দুগ্ধজাত খাদ্য, ফলমূল ও সবজি ইত্যাদির ব্যবহার বাড়তে থাকে। জমির অভাবে গৃহপালিত পশুপালন অসম্ভব হলে পশুজাত মাংসাহারের পরিবর্তে হাঁস-মুরগি ও মাছের চাষ হতে পারে, তাও সম্ভব না হলে আমিষসমৃদ্ধ শাকসবজি ও ফলমূল আহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজ দেশে উৎ পাদন হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তার সর্বোত্তম পথ।
জিয়া উদ্দিন আহমেদ: ভিজিটিং প্রফেসর, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.