দুর্ঘটনা-এই শিশুরা দায়ী করে গেল আমাদের by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

ছবিটি দেখেছি পত্রিকার পাতায়। কিশোর সন্তানের নিস্পন্দ দেহ কোলে-কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন মধ্যবয়সী মানুষটি। দুই চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি তাঁর। সেই দৃষ্টিতে ক্ষোভ, প্রশ্ন ও সর্বস্ব হারানোর বেদনা। এই মানুষটিকে আমরা চিনি না, তাঁর নামধাম-পরিচয়ও জানি না। হয়তো আলাদা করে চেনার প্রয়োজনও নেই তাঁকে।
অনেকের মধ্যে তিনিও একজন। তাঁর আর্তির সঙ্গে আজ একাকার মিরসরাইয়ের তিনটি ইউনিয়ন—মায়ানি, মগাদিয়া ও খৈয়াছড়ার সন্তানহারা আরও অনেক মা-বাবার অনন্ত হাহাকার।
গত সোমবার মিরসরাই স্টেডিয়ামে শিশুদের জাতীয় পর্যায়ের ফুটবল টুর্নামেন্টে গিয়েছিল এই শিশু-কিশোরেরা। কেউ খেলোয়াড়, কেউ সমর্থক। খেলা শেষে ট্রাকে চেপে ফিরে আসছিল ৬০-৭০ জনের দলটি। কিন্তু বাড়ি ফেরার আগেই একটি সেতু পেরোতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের ডোবায় ট্রাকটি পড়ে গেলে ঘটে দুর্ঘটনাটি। মুহূর্তেই থেমে যায় শিশুদের আনন্দ-কোলাহল। সন্তানহারা মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস।
একসঙ্গে একই বয়সী ৪০টিরও বেশি উচ্ছল শিশু-কিশোরকে হারিয়ে গ্রামগুলোতে নেমে এসেছে গভীর বিষাদ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শোকের মাতম, কে কাকে জোগাবে সান্ত্বনা? কৃষক নূরুল আমিনের সামর্থ্য ছিল না ছেলেকে পড়ানোর, তাই মামাবাড়ির আশ্রয়ে থেকে স্কুলে পড়ত শামসুদ্দিন। দুর্ঘটনা যেমন কেড়ে নিয়েছে শামসুদ্দিনকে, তেমনি তার আশ্রয়দাতা আনোয়ার হোসেনের ছেলে সাখাওয়াতকেও নিয়েছে। এ রকম বুকের পাঁজর ভেঙে দেওয়া গল্প প্রায় প্রতিটি পরিবারে। মায়ানি, মগাদিয়া, সাহেরখালী ও খৈয়াছড়া গ্রামে শুধু লাশ আর লাশ। একদিকে চলেছে কবর খোঁড়া, অন্যদিকে শ্মশানে লাশ দাহ করার প্রস্তুতি। যাদের কলকাকলিতে মেতে উঠত খেলার মাঠ, পুকুরঘাট, নদীর পাড় আর স্কুলের ক্লাসরুম—সেই দুষ্টু ছেলেদের হারানোর দুঃখ কদিনে কাটিয়ে উঠবে গ্রামের মানুষ, কেউ জানে না। কিন্তু এই শোক ছাপিয়ে উঠে আসছে কিছু প্রশ্ন, যার দায় এড়াতে পারব না আমরা, যার উত্তর খুঁজতে হবে সবাইকে।
গাড়ির মূল চালক নয়, তার সহকারী (হেলপার) গাড়িটি চালাচ্ছিল—এখানেই ছিল বিপদের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়ে চালক কথা বলছিল মুঠোফোনে। এই হঠকারিতায় যে ক্ষতিটি হয়ে গেল, তার কী সান্ত্বনা আছে? এই হঠকারিতা, নিয়ম অমান্য করার প্রবণতা নতুন কিছু নয়। আরও কত শত মৃত্যুর পেছনে এসব কারণ দায়ী, তা নতুন করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। শুধু প্রশ্ন ওঠে, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগে আরও কত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?
আমরা জেনেছি, প্রাথমিক স্কুলের খেলোয়াড়দের নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল এই প্রতিযোগিতা। টুর্নামেন্টের উদ্যোক্তা বা স্কুল কর্তৃপক্ষও কি এড়াতে পারবে দায়? বিভিন্ন এলাকার স্কুলের শিশুদের জড়ো করার দায়িত্ব যাঁরা নিয়েছিলেন, তাঁরা কি শিশু-কিশোর খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মূল ভেন্যুতে আনা-নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করেছিলেন? যেসব স্কুলের ছাত্ররা খেলায় অংশ নিয়েছিল, সেই স্কুলগুলোর পক্ষ থেকেও কি যাতায়াতের ব্যাপারে কোনো তদারকির ব্যবস্থা ছিল? এই দায়িত্বহীনতা অমার্জনীয়। বাবা-মা-অভিভাবকেরা যখন শিশুদের স্কুলে পাঠান বা স্কুলের কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে দেন, তখন তাঁদের মূল ভরসাই তো স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকেরা। তাঁরাই তখন শিশু-শিক্ষার্থীর অভিভাবক। কিন্তু বয়সের নিয়মেই উচ্ছল ও হয়তো কিছুটা অপরিণামদর্শী এই শিশুরা নিজেরাই যখন ট্রাকে চেপে বাড়ি ফেরার আয়োজন করে, তখন শিক্ষক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা আমাদের যুগপৎ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করে।
দুর্ঘটনার পর মিরসরাইয়ে ছুটে গেছেন মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনীতিক ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। তাৎক্ষণিকভাবে নিহত ছাত্রদের পরিবারকে ২০ হাজার ও আহতদের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আহত ছাত্রদের চাকরির প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জীবনের এত বড় অপচয়কে তো অর্থমূল্যে শোধ করা যাবে না, যদি না এই শোকের রেষ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই আরও মৃত্যুর আশঙ্কাকে রোধ করতে পারি।
এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ জুলাইয়ের মধ্যে ১৯১ দিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে তিন হাজার ৫২৯ জন। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে মারা গেছে ২০ জন। গত সোমবার নিহত শিশু-কিশোরেরা এই হিসাবের বাইরে। এই মৃত্যুর মিছিল ঠেকাবে কে?
প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর আইন অমান্যের প্রতিযোগিতা। কিন্তু যাঁরা নকল ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, যাঁরা ফিটনেসবিহীন গাড়িকে সড়কে চলাচলে উপযুক্ত বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, বৈধ কাগজপত্রবিহীন আটক গাড়িকে উৎকোচ পেয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন যাঁরা—সেই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যাচ্ছে জবাবদিহির বাইরে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান চলচ্চিত্রশিল্পী ইলিয়াস কাঞ্চন এ দুর্ঘটনার পর বলেছেন, ‘যত দিন না সরকার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসবে, তত দিন সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না। চালক মানুষ মারলে তার কিছুই হয় না। যদি আইন করে শাস্তির ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে এমন হতো না।’ স্বজনহারানোর বেদনা কাঞ্চন জানেন, তাই তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, আইন করতে হবে, আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। দেশে চালক তৈরির ইনস্টিটিউশন গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ চালক থাকলে দুর্ঘটনা কমবে। রাস্তার সমস্যা, ব্রিজের সমস্যা তখন মুখ্য থাকবে না। একজন ভালো চালক যেকোনো রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। অদক্ষ চালকই দেশের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
অনেক দিন ধরেই তো এসব কথা বলছেন তিনি, তাঁর মতো আরও অনেকে। কিন্তু তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নিয়ে আর কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায় সেরেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। আরেকটি কথাও এ প্রসঙ্গে জরুরি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিরসরাই এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এখানে নেই কোনো ট্রমা সেন্টার বা বিশেষায়িত হাসপাতাল। সাম্প্রতিক সড়ক দুর্ঘটনার পরও দেখেছি, স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে আহত ছাত্রদের নিয়ে ছুটতে হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর ফলে কিছু মৃত্যু ঘটেছে পথে, কিছু হাসপাতালে পৌঁছার পর সময়ক্ষেপণের কারণে।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যু আমাদের দেশে প্রায় নিয়তির মতো। মৃত্যুকে আমরা নানা সময়ে দেখেছি খুব কাছ থেকে। কিন্তু এতগুলো প্রাণোচ্ছল শিশু-কিশোরের মৃত্যুকে যেন সেই দুর্যোগের সঙ্গে মেলানো যায় না। তাদের মৃত্যু অনেক বেদনার ইতিহাসের মধ্যেও তাই ব্যতিক্রমী ট্র্যাজেডি হয়েই থাকল আমাদের জীবনে। এই শিশুরা দায়ী করে গেল আমাদের।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.