ভারত-সবখানে নাক গলাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় by কুলদীপ নায়ার

প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কার্যালয়ে গুরুতর কিছু একটা হয়েছে। যত বিতর্ক, যত কেলেঙ্কারি গিয়ে ঠেকছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। আর যেটা হচ্ছে, সব বিষয়ের মধ্যেই নাক গলাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। মনে হয়, ওখানে যত লোক দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি জড়ো হয়েছেন, আর তাঁদের মধ্যে তিনজন ভোগ করছেন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা, সেখানে কর্তৃত্ব করছেন তাঁরাই।


সন্দেহ নেই, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অতিমাত্রায় ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে এবং দেখা যাচ্ছে যে, এই ক্ষমতার কেন্দ্রটি প্রায়শই ভুল পক্ষ নিচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কী হচ্ছে না হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সেসব জানেন না। মুঠোফোনের নেটওয়ার্কে লাইসেন্স বরাদ্দ দেওয়া সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে দোষ দেওয়া চলে না। কারণ তাঁর উপদেষ্টা ও কর্মকর্তারা তাঁকে অন্ধকারে রেখেছেন।
একটা দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেছেন, তামিলনাড়ুতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যেহেতু স্থাপন করেছে রাশিয়া, তাই এর বিরুদ্ধে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। নয়াদিল্লিতে রুশ রাষ্ট্রদূতও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বিবৃতিকে সমর্থন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে অভিযোগ করেছেন, স্ক্যান্ডেনেভীয় দেশগুলো আর যুক্তরাষ্ট্র ওই সব এনজিওকে টাকা জোগাচ্ছে (আমেরিকা ভারতের এনজিওগুলোকে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি রুপি দেয়)।
পারমাণবিক জ্বালানির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সংগঠকদের বিদেশিরা টাকা দিচ্ছে—এমন অভিযোগ স্বভাবতই তাঁদের ক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু সরকার তার অভিযোগের পক্ষে বলতে গিয়ে জানিয়েছে, তিনটি এনজিওর লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। কারণ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানতে পেরেছেন যে, ওই তিনটি এনজিও বিদেশ থেকে পাওয়া টাকা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠনের কাজে ব্যবহার করছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা তো কোনো প্রমাণ নয়; বাস্তব তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, এনজিওগুলো বিক্ষোভ-সংগঠনে সত্যিই বিদেশি টাকা ব্যবহার করেছে। আসলে উধোর পিণ্ডি চাপানো হচ্ছে বুধোর ঘাড়ে। বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করছেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গ্রামে গ্রামে চর পাঠিয়ে লোকজনের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য যে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট নয়, তা বোঝা যায় এই সত্য থেকে যে, সরকার সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্সকে দিয়ে এ বিষয়ে একটি তদন্ত চালাতে চায়।
দুঃখের বিষয়, দিল্লিতে ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ভারতের পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের বিরোধী নয়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যে অভিযোগ করেছেন, এর পক্ষে তথ্য-প্রমাণ চায়। পারমাণবিক শক্তির বিষয়ে ভারতের সঙ্গে একটা চুক্তি করতে যুক্তরাষ্ট্রের বুশ সরকার যত দূর পর্যন্ত গেছে, তাতে এমন ইঙ্গিত নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র চায় না ভারত কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করুক। তবে এটা সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পারমাণবিক জ্বালানি খাতে প্রবেশ করতে দ্বিধাবোধ করছে। কারণ, এ দেশের আইন অনুযায়ী, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো ধরনের তেজস্ক্রিয়া নিঃস্বরণ ঘটলে এর দায়দায়িত্ব বর্তাবে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারীদের ওপর।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের ছাড়পত্র পেয়েও ভারত তার প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করতে পারছে না বলে নয়াদিল্লি যে হতাশ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চারপাশে বসবাসরত মানুষ যে শঙ্কা বোধ করছে, তাতেও কোনো খাদ নেই। বিশেষত, জাপানের ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে শঙ্কাটা প্রবল হয়ে উঠেছে। তারা চাইছে এমন একটা কমিটি গঠন করা হোক, যারা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করবে, যেন সেখান থেকে তারা ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। আর তামিলনাড়ু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা নিজেই যখন এ বিষয়ে নিজের সংশয়ের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে চিঠি লিখেছেন, তখন মিছে মান-ইজ্জতের কথা বলে এ নিয়ে গোঁ ধরে থাকা ঠিক নয়। সমস্যাটার গোড়ার কথা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ নয়, বরং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সম্পর্কে যেসব আপত্তি তোলা হয়েছে, সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি।
আরেকটা উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রথমসারির চারজন বিজ্ঞানীকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (আইএসআও) ও বেঙ্গালুরুভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দেভাস মাল্টিমিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যকার স্পেকট্রাম ডিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ওই চার বিজ্ঞানী। তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আইএসআরওর সাবেক প্রধান মহাদেবন নায়ার। ফলে, আইএসআরওর প্রথম ও সবচেয়ে পুরোনো সদস্য অধ্যাপক রোডড্যাম নরসিমা এই বলে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন যে, শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের শাস্তি দিয়ে ভারতের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি জগতের মানুষের মনোবল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অধ্যাপক নরসিমার পদত্যাগপত্র পেয়েছেন, কিন্তু তা গ্রহণ করেননি। তাতে কিন্তু বিষয়টা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বলা হচ্ছে, স্পেকট্রাম ডিলের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি বা টাকা সরানো হয়নি, শুধু প্রক্রিয়াগত কিছু সমস্যা ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় উপলব্ধি করতে পারছে না যে, বিজ্ঞানীদের কালো তালিকাভুক্ত করার কারণে আইএসআরওর বিজ্ঞানী মহলের মন ভেঙে যেতে পারে এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তিগত উদ্যোগের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এককথা, আর দেশের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা—খুব সতর্কতা প্রয়োজন। আসলেই যদি কোনো গোপন কলাকৌশল করা হয়ে থাকে, তবে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। এখানে কোনো স্বচ্ছতা দেখা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সব কথাবার্তা বেদবাক্য হিসেবে মানা যায় না।
অধ্যাপক নরসিমা বলেছেন, কোনো প্রতারণার ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু অভিযোগ করা হয়েছে। কালো তালিকাভুক্ত বিজ্ঞানী মহাদেবন নায়ার নতুন করে তদন্তের দাবি তুলেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে। সরকারি তদন্তব্যবস্থা ও দুষ্ট হাতের শাস্তিবিধানের ব্যবস্থাটি আগাগোড়া নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। তাঁরই কার্যালয় কী করে শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের কালো তালিকাভুক্ত করতে পারে? দীর্ঘ ২০ বছর ধরে ওই রাষ্ট্রীয় সংস্থার সঙ্গে রয়েছেন যে অধ্যাপক রোডড্যাম নরসিমা, তাঁর মতো বিজ্ঞানীর পদত্যাগের ঘটনায় এমন অসংবেদনশীল আচরণ করতে পারে? দুর্নীতিবাজদের কোনো জায়গা নেই—এ কারণেই কি চারজন বিজ্ঞানীকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে? যদি তাই হয়, তাহলে জাতির অধিকার আছে, কী ঘটেছে তা জানার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একই সঙ্গে জজ ও জুরির কাজ করতে পারে না। সেখানকার যাঁরা কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য বিজ্ঞানীদের নাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.