মহাসমাবেশের টুকিটাকি-পতাকা গুটিয়ে নিলেন মন্ত্রী

গতকাল সোমবার রাজধানীর কাকরাইলসংলগ্ন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ। পাশ দিয়েই যাচ্ছিল বিএনপির সমাবেশ অভিমুখে একটি মিছিল। সরকারের কোনো মন্ত্রীর গাড়ি- বিষয়টি মিছিলকারীদের চোখে পড়লে তিনি রোষের শিকার হতে পারেন।


এ কারণে নেওয়া হয় আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরের প্রধান প্রতিবেদক লিটন হায়দার জানান, মিছিল দেখে মন্ত্রীর নিরাপত্তাকর্মীরা দ্রুত গাড়ির পতাকা গুটিয়ে ফেলেন। এরপর মন্ত্রী গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য পথ দিয়ে সরে পড়েন। মন্ত্রীর প্রটোকলে ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, মন্ত্রীর নির্দেশে প্রথমে পতাকা খুলে ফেলা হয়। পরে তাঁরই নির্দেশে গাড়িও ঘুরিয়ে মিন্টো রোডের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।

মুড়ি, তেহারি
নয়াপল্টনসহ আশপাশের এলাকার খাবার হোটেলগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় ভ্রাম্যমাণ দোকানই ছিল সমাবেশস্থলে আসা নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভরসা। বিডিনিউজ জানায়, দুপুর দেড়টার দিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের সামনে একটি ভ্যান থেকে বড় বড় ডেকচিতে করে ভুনা খিচুড়ি আর তেহারি বিক্রি করতে দেখা গেছে কয়েকজনকে। হাফপ্লেট ১০০ আর ফুলপ্লেট ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বিএনপির মূল সভামঞ্চ থেকে কয়েক শ গজ দূরে আরো কয়েকজন বিক্রেতা ভ্যানে করে রান্না করা খাবার বিক্রি করেছেন। ভাতের সঙ্গে গরুর মাংস ২০০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে।

খালেদা জিয়া মুখ্যমন্ত্রী!
নয়াপল্টনের মহাসমাবেশে ভুল করে খালেদা জিয়াকে 'মুখ্যমন্ত্রী' অভিহিত করে বক্তব্য দেন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান শফিউল আলম প্রধান। এ বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। বিডিনিউজ জানায়, গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের আগে সমমনা দলের নেতারা বক্তব্য দেন। বক্তব্যের একপর্যায়ে জোরালো ভাষায় জাগপা প্রধান বলেন, 'এই স্বাধীনতার মাসে চিরকুমারী মুখ্যমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে আমরা আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায়
দেখতে চাই না।' এ সময় তাঁর পেছনে থাকা কয়েকজন নেতাকে 'খালেদার' পরিবর্তে 'হাসিনার' নাম বলতে শোনা যাচ্ছিল। খালেদা জিয়াও তাঁকে ডেকে কিছু একটা বলেন। এর পরই শফিউল আলম প্রধান আবারো বক্তব্য শুরু করেন। এ পর্যায়ে তিনি আবারো সেই জোরালো কণ্ঠে বলতে শুরু করেন 'চিরকুমারী মুখ্যমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা আর এক মুহূর্ত ক্ষমতায় দেখতে চাই না, চাই না।' যুবদল সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরবও স্লোগান দিতে গিয়ে ভুল করেন। স্লোগানের একপর্যায়ে তিনি বলেন, 'খালেদা জিয়ার দিন শেষ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'। এ সময় উপস্থিত নেতা-কর্মীরা তাঁকে সংশোধন করতে বলেন।

মহিলা দল-শিবির হাতাহাতি
মহাসমাবেশে মহিলা দলের কর্মীদের অবস্থানের জন্য নির্ধারিত স্থানের পশ্চিম পাশেই শিবিরকর্মীদের জন্য স্থান বরাদ্দ করা হয়। তখন বিকেল সাড়ে ৪টা। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদ বক্তব্য শুরু করেছেন। এ সময় শিবিরকর্মীরা মহিলা দলের ব্যারিয়ার ভেঙে এগিয়ে এসে অবস্থান নিলে উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সৃষ্টি হয় উত্তেজনা। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর জানায়, মহাসমাবেশ মঞ্চের ঠিক উল্টো দিকে রাস্তার দক্ষিণ পাশে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হাতাহাতির এ ঘটনা ঘটে।

টাকা বিতরণ
ঘটনাস্থল কাকরাইল মোড়। হঠাৎ দেখা গেল খুলনা জেলা বিএনপির কর্মীদের মাঝে প্রকাশ্যেই ৫০০ টাকা করে বিতরণ করছেন খুলনা জেলা বিএনপির সহ্নীড়া সম্পাদক ইউনুস মোল্লা। এ নিয়ে কয়েকজন কর্মী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, জনপ্রতি আরো বেশি টাকা বরাদ্দ ছিল, দেওয়া হচ্ছে কম। খুলনা জেলা বিএনপি নেতা ইউনুস মোল্লার কাছে সাংবাদিকরা টাকা বিতরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, 'এ টাকা অন্য কারণে দেওয়া হয়েছে।'

'কোন দলের হরতাল?'
মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুরো ঢাকা শহরেই হরতালের আবহ বিরাজ করছে। রাস্তায় কোনো গণপরিবহনের দেখা মেলেনি। নগরীর দোকানপাট ছিল বন্ধ। গণপরিবহন না থাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেই ভোগান্তিতে পড়ে। শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন আসকর শেখ (৭৫)। যাবেন নিজ বাড়ি কুমিল্লায়। সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কোনো বাসের দেখা পাননি তিনি। রাস্তায় গাড়ি না পেয়ে আসকর শেখ কালের কণ্ঠের প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান, 'বাবা, এইড্যা কোন দলের হরতাল? হরতালের কথা তো আগে হুনি নাই।' পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ষাটোর্ধ্ব উসমান আরেফিন উত্তরে বলেন, 'সারা জীবন বিরোধী দল হরতাল দিয়ে আসছে, কিন্তু রাস্তাঘাটের এই অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এই প্রথম কোনো সরকারি দল হরতাল দিছে।' পথচারী আইনুল হক বলেন, 'হরতালে তো কিছু কিছু গাড়ি রাস্তায় চলতে দেখা যায়। আজকে তো তাও চলছে না।'

পচনশীল পণ্য নিয়ে বিপাকে
বিশ্বরোডের দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর কাঁচা-পাকা ফলের আড়ত 'মেসার্স কেয়া বাণিজ্যালয়'। গতকাল দুপুরে দেখা যায়, আড়তের কয়েক শ তরমুজ মাটিতে রাখা আছে, কোনো ক্রেতা নেই। আড়তের পরিচালক আলম কালের কণ্ঠকে জানান, ঠাকুরগাঁও থেকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে রবিবার তিনি এক ট্রাক তরমুজ এনেছেন। অন্যদিন আনা তরমুজ পরদিন সকালেই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু রবিবার আনা তরমুজ সোমবার দুপুর পর্যন্তও বিক্রি করতে পারেননি। এর মধ্যে অনেক তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি জানান, দেড় লাখ টাকার তরমুজের মধ্যে ৭০ হাজার টাকার বেশি লোকসান হবে। একই অভিযোগ অনেক তরকারি ও পচনশীল মাল বিক্রেতার। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের ব্যবসায়ী হেদায়েত আলী বলেন, রবিবার রাতেও ট্রাকে করে বিভিন্ন এলাকা থেকে মাছ আনা হয়। কিন্তু বিক্রেতারা ১০ শতাংশ মাছও বিক্রি করতে পারেননি।

মেডিক্যাল সনদ নিয়ে
রশিদ হাওলাদার খুলনার খালিশপুরের তাঁতী দলের সাধারণ সম্পাদক। সুস্থ শরীর নিয়েই তিনি ঢাকা এসেছেন, মহাসমাবেশে যোগ দিয়েছেন। তবে তাঁর সঙ্গে ছিল একটি ডাক্তারি সনদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বাধা দেওয়ার ভয়ে আমরা অনেকেই এ কৌশল বেছে নিয়েছি।' তিনি জানান, শুধু খুলনা থেকেই এ ধরনের সার্টিফিকেট নিয়ে দুই শতাধিক নেতা-কর্মী ঢাকায় এসেছেন। তাঁরা সরাসরি না এসে প্রথমে কাউখালি, সেখান থেকে বরিশাল এবং বরিশাল থেকে ভেঙে ভেঙে (রিকশা, সিএনজি, টেম্পো ইত্যাদি যোগে) ঢাকা আসেন। পুলিশ বাধা দিলে বলা হবে চিকিৎসার জন্য ঢাকা এসেছেন- এ ছিল মেডিক্যাল সনদের উদ্দেশ্য।

'নির্দেশ সরকারের নয়'
সরকারের তরফ থেকে যানবাহন বন্ধের কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি বলে গতকাল দাবি করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, 'বিরোধী দল দুই সপ্তাহ ধরে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সে জন্যই সাধারণ জনগণ তাদের যানবাহন রাস্তায় নামায়নি। সরকারের তরফ থেকে যানবাহন বন্ধের কোনো ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বরং আমরা জনজীবন স্বাভাবিক করতে চাইছি।' বিএনপি কর্মসূচির নামে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে- এমন দাবি করে তিনি বলেন, 'সে জন্য সরকারি দলের দায়িত্ব রয়েছে সরকারকে সহায়তা করা। আমরা সে দায়িত্বই পালন করছি।'

জামায়াতের সেই বুলি
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের মুক্তি চেয়ে মহাসমাবেশে বেলুন ওড়ায় জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। বিডিনিউজ জানায়, গতকাল সকালে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের বেশ কয়েকটি মিছিল কাকরাইলের নাইটিংগেলের মোড় দিয়ে সমাবেশস্থলে প্রবেশ করে মঞ্চের পশ্চিমে স্বেচ্ছাসেবক ও মহিলা দলের পাশে অবস্থান নেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এই মহাসমাবেশের মূল দাবি হলেও জামায়াত ও শিবিরের স্লোগানে নেতাদের মুক্তির কথাই ঘুরেফিরে এসেছে। মিছিলে আটক জামায়াত নেতাদের ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করতে দেখা গেছে শিবিরকর্মীদের।

No comments

Powered by Blogger.