তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীর-আর হলো না 'কাগজের ফুল'

নিষাদ। এক বছরের বেশি তার বয়স। অবুঝ এই শিশুটি এখনও জানে না মৃত্যু কী। মৃত্যু সংবাদের কোনো আলাদা মর্মও হয়তো তার কাছে নেই। কিন্তু আজ থেকে শিশুটি দেখতে পাবে না তার প্রিয় বাবাকে। মাকে ফিরে পাবে কি-না তাও নিশ্চিত নয়। শিশুটির বাবা চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ গতকাল মানিকগঞ্জে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।


গুরুতর আহত হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন মা চলচ্চিত্রকার ক্যাথেরিন মাসুদ। তারেক ও ক্যাথেরিন দম্পতি মাইক্রোবাসে করে মানিকগঞ্জ গিয়েছিলেন পরবর্তী সিনেমা 'কাগজের ফুল'-এর শুটিং স্পট দেখতে। সঙ্গে গিয়েছিলেন সিনেমাটির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীর তারেক মাসুদের সর্বশেষ সিনেমা 'রানওয়ে'র সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন। বিদেশি নানা টিভি চ্যানেলের অভিজ্ঞ ক্যামেরা ক্রু মিশুক মুনীর 'কাগজের ফুল' সিনেমাতেও হয়তো সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্ব পালন করতেন। হলো না। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক চৌধুরীও নিহত হলেন একই দুর্ঘটনায়। নিহত হলেন চিত্রশিল্পী জামান, ক্যামেরা সহকারী ওয়াসিম, গাড়িচালক মুস্তাফিজও। একটি ঘাতক বাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে গেল তারেক মাসুদ ও সহযাত্রীদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি। জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল চোখের পলকে। ক্যাথেরিন মাসুদ ছাড়াও গুরুতর আহত হয়েছেন চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন ও দিলারা বেগম জলি। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ নিহতদের জন্য আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি। শোকাহত পরিবারগুলোর জন্য আমাদের সমবেদনা। যারা গুরুতর আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। আশা করি, যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে আহতদের সারিয়ে তোলার সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনে তারেক মাসুদ প্রতিভাবান নির্মাতা হিসেবেই খ্যাত। আশির দশকের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারেক মাসুদ সিনেমায় প্রবেশ করেছিলেন। শিল্পী এসএম সুলতানকে নিয়ে নির্মিত 'আদম সুরত' সবাইকে চমকে দিয়েছিল। এরপর 'মুক্তির গান' বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নতুন আলোয় দেখিয়েছিল। 'মুক্তির কথা'ও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। 'মাটির ময়না' পেয়েছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। অন্তর্যাত্রা, রানওয়ে, নরসুন্দরও বোদ্ধা দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছিল। বলা হচ্ছিল, 'মাটির ময়না'র পর 'কাগজের ফুল'ই হবে তার সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী সিনেমা। কিন্তু আর হলো না 'কাগজের ফুল'। শুধু এ সিনেমাই নয়_ প্রতিভাবান এ চলচ্চিত্রকার ও তার সহযোগীদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনেক আশা ও স্বপ্নের সমাধি ঘটল। মানিকগঞ্জের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর সবার মুখে একটিই প্রশ্ন_ আর কত মূল্যবান প্রাণের অপচয় ঘটলে আমাদের সড়কগুলো নিরাপদ হবে? মিরসরাই ট্র্যাজেডির পর কিছু সময়ের জন্য সচেতনতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ওই দুর্ঘটনার পর একের পর এক আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এমন দিন খুব একটা মেলে না যেদিন ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে না। এমন অবস্থায় রাস্তায় চলাচল মানেই হাতে প্রাণ নিয়ে বের হওয়া। বেপরোয়া গাড়ি চালনা, প্রশিক্ষণহীন চালক, ত্রুটিযুক্ত অচল রাস্তাসহ অনেক কারণই এর জন্য দায়ী। এগুলো সমাধান অযোগ্য সমস্যা নয়। সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু শত দাবি-দাওয়া, অনুরোধ সত্ত্বেও তা হচ্ছে না। তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরের মতো প্রতিভাবান মানুষের মৃত্যুর পরও হয়তো আরও অনেক দুর্ঘটনা দেখতে হবে আমাদের। কিন্তু আমরা কোনো দুর্ঘটনা দেখতে চাই না। আমরা চাই সড়ক নিরাপদ হোক। মানুষের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে সরকার বিশেষ মনোযোগ দিক। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে মানুষ চলাচল করবে কীভাবে?
 

No comments

Powered by Blogger.