সুন্দরবনের গাছ, কপোতাক্ষের মাটি কেটে তৈরি হচ্ছে ইট by সুমন্ত চক্রবর্ত্তী

খুলনার পাইকগাছায় কপোতাক্ষ নদে ছোট ছোট অসংখ্য বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধের ভেতর জমা হওয়া পলিমাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে নদের পাড়ের তিনটি ইটভাটায়। এসব ভাটায় পাশের সুন্দরবন থেকে কেটে আনা গাছ পোড়ানো হচ্ছে। সেই গাছ চেরাই করতে ভাটা এলাকায় বসানো হয়েছে একটি করাতকল।


এদিকে, নদের এক কিলোমিটারজুড়ে বাঁধের কারণে নৌ-চলাচলে ব্যাহত হচ্ছে বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন। ড্রাম চিমনির ভাটাগুলোর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই।
উপজেলার ৯ নম্বর চাঁদখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনসুর হাজি বলেন, ‘নদী তো বুঝে (বন্ধ) গেছে। এখন নৌকা চলতে পারে না। দুই-তিন বছর আগেও বড় বড় নৌকা চলত। ইটভাটার জন্যি এমন অবস্থা হয়েছে।’
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, সুন্দরবন থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে পাইকগাছার কাটাখালী বাজার। বাজারের পশ্চিমে দেবদুয়ার গ্রাম। সেই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের দক্ষিণ পাশে ইটভাটা তিনটি অবস্থিত। কাটাখালী বাজার থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে শুরুতেই পড়বে সরকারি একটি আশ্রয়কেন্দ্র। এর ১০০ গজের মধ্যেই আছে এমএকে ব্রিকস। এটির মালিক অহেদুজ্জামান। এমএকের আধা কিলোমিটার পশ্চিমে রয়েছে কামরুল হোসেন খানের বিএকে ব্রিকস। তারও আধা কিলোমিটার পশ্চিমে মহিউদ্দিন হোসেন খানের বিএসকে ব্রিকস। শেষের দুটি ইটভাটার মাঝখানে আরেকটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে বর্তমানে ১৪টি পরিবার বাস করে। ঘূর্ণিঝড় আইলাদুর্গতদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার আশ্রয়কেন্দ্র দুটি করে দিয়েছিল। শুরুতে ৫০-৬০টি পরিবার ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারী এক নারী জানান, ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলোবালিতে বাড়িতে থাকা দায়। তাই এখানে আর বেশি দিন থাকবেন না তাঁরা।
জানা গেছে, বিএসকে ইটভাটা চালু হয় ২০০৯ সালে। এমএকে ও বিএকে ভাটা দুটি নির্মিত হয় ২০০৭ সালে। তখন থেকেই কপোতাক্ষের বুকে বাঁধ দেওয়া শুরু হয়। দিন দিন বাঁধের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
নদের বুকে দখলবাজি: কপোতাক্ষের পাড় থেকে মাঝবরাবর ৫০-৬০ ফুট ভেতরে ঢুকে ছোট ছোট বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধগুলোর কারণে ছোট পুকুরসদৃশ জায়গা তৈরি হয়েছে। এতে প্রায় ১০০ ফুট চওড়া নদটি সরু হয়ে এসেছে। ভাটার সময় নদের খোলা অংশ শুকিয়ে যায়। আর জোয়ারের সময় যা-ও পানি থাকে, তাতে নৌকা চলাচল করতে পারে না। বর্ষাকালে এসব বাঁধের কারণে নৌ-চলাচল ব্যাহত হয়। তবে নদের ওই এক কিলোমিটারের দুই পাশে নৌ-চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।
এলাকাবাসী ও ইটভাটার কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদে জোয়ার এলে বাঁধের কিছু অংশ কেটে দেওয়া হয়। তখন বাঁধের ভেতরে জোয়ারের পানির সঙ্গে আসা পলি জমা হয়। সেই পলিমাটি কেটে নিয়ে ভাটায় ইট তৈরির কাজ চলে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান দীলিপ দত্ত বলেন, মানুষ দুভাবে নদী হত্যা করে—এক, নদী দখল করে ইটভাটা বানিয়ে; দুই, নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছের চাষ করে। বাঁধ দিলে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ রুদ্ধ হয়ে যায়। তখন পলি জমে ভরাট হয়ে একসময় নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এক-দেড় বছর আগেও নদের অবস্থা এমন ছিল না। তখনো বড় ট্রলারগুলো এদিক হয়ে সাতক্ষীরা ও যশোরে চলাচল করত। এখন একটি ছোট নৌকা যেতেও কষ্ট হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা খানপাড়ার হাফিজ বলেন, ‘একসময় কপোতাক্ষ অনেক বড় ছিল। এখানকার ভাটার মালিকেরা একটু একটু করে দখল করতে করতে এখন প্রায় মেরে ফেলেছেন। কিছুদিন পর নদী আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
পুড়ছে কাঠ: ভাটাগুলোতে পোড়ানোর জন্য ট্রলারে করে সুন্দরবন ও বরিশাল থেকে কাঠ আসছে। সুন্দরবনের গেওয়া, কেওড়া ও ধুন্দল কাঠের সঙ্গে বরিশাল থেকে আসছে শিরীষ, তাম্বুল ও চটকা। সুন্দরবন থেকে আনা কাঠ ভাটার পাশে বাঁধের ভেতর ডুবিয়ে রাখা হয়।
দেবদুয়ার গ্রামের কামাল খান বলেন, সুন্দরবন থেকে আনা কেওড়া কাঠ ভাটা এলাকায় রাখা হয়। গেওয়া ও ধুন্দল পানিতে ভেজানো থাকে। পরে তা তুলে পোড়ানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভাটার এক শ্রমিক জানান, কখনো সপ্তাহের সাত দিনই ট্রলারে করে কাঠ আসে। কখনো কখনো এক দিন পর আসে ট্রলার।
করাতকল: কাঠ চেরাইয়ের জন্য তিন ভাটার মাঝের বিএকে ব্রিকসে একটি করাতকল বসানো হয়েছে। এখান থেকে বাকি দুটি ইটভাটার মালিকেরাও তাঁদের কাঠ চেরাই করান। করাতকলটি শ্যালোচালিত ইঞ্জিনে চলে।
কাটাখালী বাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নদীপথে কাঠ এসে সরাসরি করাতকলের সামনে নামে। ওই কাঠ বাজারে এনে চেরাই করতে গেলে খরচ যেমন বেশি পড়ে, তেমনি লোক জানাজানির ভয় থাকে। তাই ভাটার পাশেই করাতকলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ভাটার শ্রমিক জানান, দীর্ঘদিন থেকে এখানে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। এখানে প্রায় প্রতিদিন কয়েক শ মণ কাঠ চেরাই হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য: বিএসকে ব্রিকসের অংশীদার মোশারেফ হোসেন খান জানান, তাঁর ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। তিনি বলেন, ‘এখানে যারা আছে, তারা সবাই কাঠ দিয়ে ইট পোড়াচ্ছে।’ কাঠ কাটার জন্য করাতকল বসানোর কথা স্বীকার করেছেন তিনি। নদের মধ্যে বাঁধ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি একাই শুধু বাঁধ দিইনি। অন্য ভাটার মালিকেরাও দিয়েছেন।’
এমএকে ব্রিকসেরও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই বলে স্বীকার করেছেন এর ব্যবস্থাপক হান্নান। ড্রাম চিমনি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না, মালিক জানেন।’ নদ দখল করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের সঙ্গে একটু যোগাযোগ না থাকলে কি এভাবে ভাটা করা যায়?’
পানি উন্নয়ন বোর্ড, খুলনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) বিদ্যুৎ কুমার সাহা বলেন, ‘বিষয়টি জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব। সত্যতা পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’
পাইকগাছা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘ওদের অনেক সমস্যা আছে। আমি বলেছিলাম জমি ইজারা নিতে, ওরা নেয়নি। শিগগির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর, খুলনার উপপরিচালক তরুণ কান্তি শিকদার বলেন, শিগগির এই ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.