অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ-আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা চাই

বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার সময়েও বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির উচ্চহার বজায় রাখতে পারছে_ সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে এ দাবি করার সময়ে গর্বের প্রকাশ থাকে যথেষ্টই। জিডিপি বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া_ এ ধরনের কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরে এমন দাবি করাই যায়।


তিন বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বাড়ানো হয়েছে_ এ অর্জনকেও খাটো করে দেখা যাবে না। তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশের অভিমত, অর্থনীতির ভেতরে ক্রমাগত ক্ষরণ চলছে এবং তা থেকে পরিত্রাণের সঠিক পথ অনুসরণ করা হচ্ছে না। রোববার মর্যাদাশীল গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডি চলতি অর্থবছরের সামষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে অভিমত দিয়েছে, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা চলছে। তারা বলেছে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে। আবার সরকার যা ব্যয় করছে তাতে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের পরিমাণ তুলনামূলক কম, অনুন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে ৫০ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকার ঋণের বোঝা বাড়িয়ে চলেছে। রোববার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি হবে ৪৬ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা, যা চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তিনি স্বীকার করেন, জ্বালানি খাতের ভর্তুকি মেটাতে এবং সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের প্রভাবে মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে। এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার যে মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে তাতে 'মূল্যস্ফীতি তো কমবেই না, বরং প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে' বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সিপিডি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংকিং খাত থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ পেতে সমস্যায় পড়ছে। এর প্রভাবে বিনিয়োগের গতি শ্লথ হবে, যা দেশের কৃষি-শিল্প-সেবা খাতে উৎপাদন বাড়িয়ে চলার লক্ষ্য অর্জন মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে এবং কাজ প্রত্যাশী লাখ লাখ মানুষের মিছিল আরও দীর্ঘ করবে। বেসরকারি খাতে ঋণ সংকোচনের পাশাপাশি সরকারের নিজের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের চিত্রও হতাশাব্যঞ্জক। অর্থমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, বছরের প্রথম ছয় মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাত্র ২৭ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। বিদেশি ঋণ-অনুদান ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে কম। রফতানি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। এ অবস্থায় বছরে সাত শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না, এটা তিনিও বুঝতে পারছেন।
আমরা মনে করি, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দ্রুত কাটিয়ে তুলতে সরকারকে মনোযোগী হওয়া উচিত। সংসদে অর্থমন্ত্রী গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য আরও বাড়ানোর ধারণা দিয়েছেন। এর প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার আরও অস্থির হবে। যানবাহন ভাড়া বাড়বে। যে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করে বিনিয়োগের গতি শ্লথ করা হচ্ছে, এ পদক্ষেপে তা আরও বাড়তে পারে। জনগণও তেল-গ্যাসের মূল্য আরেক দফা বাড়ানোর পদক্ষেপকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। এর পরিবর্তে কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সরকারের রাজস্ব ব্যয় নিয়ন্ত্রিত করার প্রতিই বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে অপ্রয়োজনীয় কিংবা রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প বাদ দিতেও দ্বিধা করা উচিত নয়।

No comments

Powered by Blogger.