কালান্তরের কড়চা-বিএনপির কর্মসূচি আওয়ামী লীগ সরকারই সফল করে দিল by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া (র.)কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি এত ভদ্রতা ও আদব-তমিজ শিখেছেন কার কাছ থেকে? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, 'বেয়াদবের কাছ থেকে। বেয়াদব যা করে এবং বলে, আমি তার উল্টোটা করি ও বলি এবং এই উল্টো কাজই হচ্ছে আদব বা ভদ্রতা।


বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আচরণ কাকে বলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তা শিখতে পারত বিএনপি-জামায়াতের গত সরকারের আচরণ থেকে। অর্থাৎ খালেদা-নিজামীর সেই সরকার তখন যা করেছিল, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তার উল্টো কাজটি করে, তারা যে গণতান্ত্রিক সরকার এবং তাদের আচরণ যে গণতান্ত্রিক- এটার প্রমাণ দিতে পারত। বিএনপির ডাকা ১২ মার্চের সমাবেশের দিনটি আওয়ামী লীগ সরকারকে সেই সুযোগই দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার সেই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারল না। তারা গত বিএনপি সরকারের কাজের অনুকরণ করতে গিয়ে তাদের অভিসন্ধিই সফল করে দিল।
১১ মার্চ রবিবার সকালে লন্ডনের বাসায় বসে ঢাকার একটি দৈনিকের জন্য আমার নিয়মিত কলামটি লিখছিলাম। সেই দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগ থেকে সহসা টেলিফোন আসতে লাগল, লেখাটি তাড়াতাড়ি পাঠান, নইলে আজ কাগজে ধরাতে পারব না। জিজ্ঞেস করেছি, কেন পারবেন না? প্রতি সপ্তাহে তো এ সময়েই লেখা পাঠাই। তারা বলল, সারা ঢাকা শহর বলতে গেলে যানবাহনশূন্য। বাস-ট্রাক খুবই কম চলছে। হোটেল-দোকানপাট সব বন্ধ। দূরপাল্লার বাস-লঞ্চও শহরে আসছে না। শহরের প্রতিটি এন্ট্রি-পয়েন্টে কড়া পুলিশ পাহারা। আমাদের অফিসে কাজের লোকজন অনেকেই আসতে পারেনি। আমরা যারা এসেছি, তারাও বাসায় ফিরব কী করে, তা জানি না। আপনার লেখাটি দয়া করে তাড়াতাড়ি পাঠান। আমরা দ্রুত করে বাসায় ফেরার উপায় খুঁজতে চাই।
আমি একটু বিস্মিত হয়েছিলাম। ১২ মার্চ বিএনপির 'ঢাকা চলো' অভিযান। তার আগের দিনই রাজধানীর যান চলাচল, জনজীবন স্থবির হয়ে গেল কেন? তাহলে বিএনপি কি তাদের কর্মসূচির আগের দিন হরতাল ডেকেছে? কিন্তু তাদের ডাকা হরতালে তো রাজধানীতে এমন অচলাবস্থা কখনো সৃষ্টি হয়নি। দৈনিকটির সম্পাদকীয় বিভাগকে এই অচলাবস্থার কারণ জিজ্ঞেস করতেই তারা বলল, বিএনপি হরতাল ডাকেনি। তাদের ১২ মার্চের জনসমাবেশ বন্ধ করার জন্য সরকারই নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঢাকা শহর সম্পূর্ণ অচল করে দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতকে কিছুই করতে হয়নি।
মনে পড়ল, বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে এক ৩০ এপ্রিলের ঘটনা। এই সময় আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দল। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছিলেন, সেই বছর ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সরকারের পতন ঘটবে। কিভাবে এই পতনটি ঘটবে, সে কথা তিনি পরিষ্কার করে বলেননি। কিন্তু সেই হুমকিতেই কাজ হয়ে গিয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত সরকার এত ভীত হয়ে পড়েছিল যে তারা গণতান্ত্রিক সব আচার-আচরণ ভুলে স্বৈরাচারী কায়দায় আওয়ামী লীগের ঢাকা সমাবেশ ব্যর্থ করার জন্য স্বৈরাচারী চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছিল।
আজ ২০১২ সালের ১২ মার্চ ঢাকা শহর যেমন অবরুদ্ধ, তখন এপ্রিল মাসের পুরো দুটো দিন ঢাকা শহর ছিল সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। তৎকালীন বিএনপি সরকারই এই অবরোধটি তৈরি করেছিল। আওয়ামী লীগকে কিছু করতে হয়নি। তাদের ঢাকা সমাবেশের দিনের কয়েকদিন আগে থেকেই ঢাকা শহরে বাস, লঞ্চ, এমনকি ট্রাক, লরি এবং দূরপাল্লার ট্রেনও আসতে দেওয়া হয়নি। বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা চলাচল পর্যন্ত বন্ধ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়েছিল। প্রশিকা নামের একটি এনজিও আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং ঢাকা অবরোধে তারা তাদের হাজার হাজার কর্মী দিয়ে সাহায্য জোগাবে- এই সন্দেহে এই সংস্থাটির ওপরও ক্রাশডাউন করা হয়। প্রশিকার তৎকালীন প্রধান কাজী ফারুককে নানা হয়রানির পর গ্রেপ্তার করা হয়।
আওয়ামী লীগকে কিছু করতে হয়নি। বিএনপি-জামায়াত সরকারই তাদের কর্মসূচি সফল করে দিয়েছিল। বাইরে থেকে লোক আসতে পারেনি। কিন্তু যারা পুলিশি বাধা এড়িয়ে এসেছে তারা এবং ঢাকার মানুষই আওয়ামী লীগের সমাবেশকে বিরাট সাফল্য দিয়েছে। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত সরকারের পতন হয়নি। আওয়ামী লীগ ঢাকা অবরোধের এবং সরকারের পতন ঘটানোর ডাক দিয়েও সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। কিন্তু সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক দমননীতির ফলে আওয়ামী লীগের একটি মূল উদ্দেশ্য সফল হয়। বিএনপি-জামায়াত সরকার দারুণভাবে ভীত হয়ে আরো স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় দেশ শাসন শুরু করে। প্রতি পদক্ষেপে ভুল করতে থাকে এবং তাদের পতনের দিনটি ত্বরান্বিত হয়।
বিএনপির ১২ মার্চের ঢাকা চলো অভিযান ব্যর্থ করতে গিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যা করল, তা গত বিএনপি-জামায়াত সরকারেরই স্বৈরাচারী পন্থার অনুকরণ এবং নিজেদের কার্যক্রম দ্বারাই সরকার প্রমাণ করল, তারা বিএনপি-জামায়াত জোটের হুমকিতে ভীত। রাজনৈতিকভাবে তাদের হুমকি মোকাবিলার মতো জনসমর্থন অথবা সাংগঠনিক শক্তি না থাকার দরুন আওয়ামী লীগ সরকারও আজ স্বৈরতান্ত্রিক পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। এই পন্থা এখন আপাতত বাঁচাবে। কিন্তু এর শেষ পরিণাম কী?
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগের ঢাকা অবরোধের প্রচেষ্টা দ্বারা যেমন সরকারের পতন ঘটানো যায়নি, তেমনি বিএনপি ও জামায়াত সংঘবদ্ধ হয়ে ১২ মার্চের ঢাকা চলো অভিযান দ্বারা যে সরকারের পতন ঘটাতে পারবে না, এটা একটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। তবু আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক দল এবং সরকার হঠাৎ এমন করে বিএনপি-জামায়াতের হুমকিতে এতটা ভীত হয়ে পড়ল কেন? কথায় বলে, যে মেঘ বেশি গর্জায়, তা বিদ্যুতের চমক সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু বজ্রপাত ঘটাতে পারে না। বিএনপি নেতা-নেত্রীরা ইদানীং খুব গর্জাচ্ছেন যে ঢাকায় হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা আরব-স্প্রিংয়ের মতো গণ-অভ্যুত্থান ঘটাবেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরাও জানেন যে সে ক্ষমতা ও জনসমর্থন তাঁদের নেই।
ঢাকা এবং কায়রোর পরিস্থিতি ভিন্ন। কায়রোয় ৩০ বছর ধরে মুবারকের স্বৈরাচারী শাসনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল; ঢাকায় হাসিনা সরকার একটি নির্বাচিত সরকার এবং দেশকে সুশাসন উপহার দিতে না পারলেও স্বৈরতান্ত্রিক অত্যাচার তারা দেশে চালায়নি। নানা অভাব-অভিযোগে এই সরকারের ওপর দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ, কিন্তু অভ্যুত্থান দ্বারা এই সরকারকে হটানোর জন্য তারা প্রস্তুত নয়, আগ্রহীও নয়। তারা খালেদা-নিজামী সরকারের শাসনামলও দেখেছে। তার তিক্ত অভিজ্ঞতা তারা এখনো ভোলেনি।
১২ মার্চে কী হতে পারে, সে সম্পর্কে দুই দিন আগেও আমি আমার এক কলামে লিখেছি, বিএনপি যতই হম্বিতম্বি করুক, তাতে ভীত না হয়ে আওয়ামী লীগের উচিত, গণতান্ত্রিক পন্থায় এই হুমকির মোকবিলা করা। অর্থাৎ তাদের ঢাকা সমাবেশে কোনো বাধা না দেওয়া। এই সমাবেশের পেছনে জামায়াতিরা ওত পেতে আছে- এ কথা সত্য। তাদের উদ্দেশ্য, বিএনপির সহায়তায় দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানো। সুতরাং ১২ মার্চ দেশে বা ঢাকা শহরে কোনো নাশকতামূলক কাজ যদি হয়, তা করবে জামায়াত-শিবির এবং তাদের অনুগত উগ্র মৌলবাদী সংগঠনগুলো। এদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও র‌্যাবকে কঠোর ও সতর্ক অবস্থান নিতে হবে।
কিন্তু কোনো কারণেই জনসমাবেশ ভণ্ডুল করার কার্যক্রম সরকার গ্রহণ করবে না। কারণ বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদসভা ও জনসভা করা বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। এই অধিকার কোনো গণতান্ত্রিক সরকার হরণ করতে পারে না। যদি দেখা যায়, এই মিটিং-মিছিল দ্বারা বিরোধী দল দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে চায়, তাহলে সরকার অবশ্যই শক্তি প্রয়োগ দ্বারা তা দমন করবে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করবে। তখন দেশের মানুষও বুঝবে, এটা স্বৈরাচারী পন্থায় দমননীতি কার্যকর করা নয়; জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থেই সরকারের শক্তি প্রয়োগ। কিন্তু এবার ১২ মার্চের সমাবেশ বন্ধ করার জন্য সরকার আগাম যে ব্যবস্থা গ্রহণ করল, তাতে বিএনপির হুমকির মুখে তাদের ভীত মনের প্রতিচ্ছবিটাই ফুটে উঠেছে এবং এটা তাদের একটা বিরাট নৈতিক পরাজয়।
১২ মার্চ লন্ডন সময় সকাল সাড়ে ৯টায় আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, তখন খবর পেয়েছি, সারা ঢাকা শহরটাকে গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেও বিএনপির জনসমাবেশ সরকার ঠেকাতে পারেনি। পুলিশের নির্দিষ্ট করে দেওয়া এলাকা উপচে মানুষের ভিড় বাড়ছে। জনসভার কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার জন্য বিএনপি এক দিন বা দুই দিনের জন্য হরতালের ডাকও দিতে পারে বলে শুনছি। আরো কঠোর কর্মসূচিও গ্রহণ করতে পারে। আমার ধারণা, সরকারের তাতেও ভীত হওয়ার বা বাধাদানের নীতি গ্রহণের দরকার নেই।
বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে দেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটানো সম্ভব নয়। এত আন্দোলন করার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ আওয়ামী লীগ কি সে কথা বুঝছে না? সরকারের দায়িত্ব উগ্র ও ধ্বংসাত্মক মৌলবাদীদের সর্বশক্তি প্রয়োগে হটানো। বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক অধিকারে বাধা প্রদান নয়। বিরোধী দল নিয়মতান্ত্রিক অধিকারের সীমা অতিক্রম করলে তখন প্রশ্ন উঠবে শক্তি প্রয়োগ দ্বারা তা প্রতিহত করার। তার আগে নয়। ১২ মার্চের জনসমাবেশের কর্মসূচিতে বাধাদানের জন্য আগের দিন থেকেই ঢাকা শহরকে কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কার্যক্রম হতে পারে না। এই কার্যক্রম দ্বারা তারা বিএনপির উদ্দেশ্যই সফল করে দিল। এটা শুধু এই সরকারের জন্য নৈতিক পরাজয় নয়; তাদের ভবিষ্যতের জন্যও অশনিসংকেত।
এই লেখাটা লিখতে লিখতে আমি মনে মনে প্রার্থনা করছি, ঢাকায় আজকের (১২ মার্চ) সমাবেশে জামায়াতিদের প্ররোচনায় খালেদা জিয়া যেন কোনো উসক্ানিমূলক বক্তৃতা না দেন এবং জনসভার পর কোনো ধরনের দাঙ্গা-হাঙ্গামা উস্কে না দেন। যদি দেন, তাহলে সরকারের ব্যর্থ ও ভ্রান্ত দমননীতির জন্য তাঁরা 'ঢাকা চলো অভিযান' কর্মসূচিতে যতটুকু সাফল্য অর্জন করেছেন, তা খোয়াবেন এবং দেশের মানুষ বুঝতে পারবে, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য জামায়াতিদের দ্বারা প্ররোচিত ও প্রভাবিত হয়েই বিএনপির এই আন্দোলন। এর পেছনে জনগণের দাবিদাওয়া আদায়ের সংগ্রাম করার কোনো উদ্দেশ্য নেই। অন্যদিকে এই প্রার্থনাও করি, ছাত্রলীগের 'বীর পুঙ্গবেরা' এই জনসমাবেশ শেষে পুলিশের আশ্রয়ে বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের, এমনকি শিবিরের কর্মীদের ওপরও কোনো হামলা চালিয়ে শহরকে যেন রণাঙ্গনে পরিণত না করে। তা যদি তারা করে, তাহলে বিএনপি-জামায়াতের হাতে আরো শক্তি জোগানো হবে।
১২ মার্চের দিনটি কেমনভাবে কাটবে- তা এখনো জানি না। ভালোয় ভালোয় কাটুক- এটা আমার প্রার্থনা। আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে এখন দুস্তর পারাবার। আমরা শুধু কাণ্ডারিদের হুঁশিয়ার করতে পারি। তাঁরা যদি হুঁশিয়ার না হন, তাহলে ভবিষ্যতের কথা ভবিতব্যই জানে।

লন্ডন, ১২ মার্চ, সোমবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.