রিকশা উচ্ছেদ ও নাগরিক ভোগান্তি by এম শওকত আলী

শৈশবকালে পুঁথিতে পড়েছিলাম_ 'ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল'। আমাদের রাজধানী শহরের একশ্রেণীর শিক্ষিত (?) লোকের অবস্থাও প্রায় সেই রকমের দেখা যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বললেও ছ্যাকড়াগাড়ির কথা অনেকেই ভুলতে পারছেন না।

গত ৫ আগস্ট সমকালের 'খোলা চোখে' পাতায় প্রকাশিত আমানুল্লাহ নোমানের লেখা 'রিকশা উচ্ছেদ ও নাগরিক ভোগান্তি' শিরোনামে লেখাটি পড়ে সেরকমই মনে হলো। ভদ্রলোক জানেন কি-না জানি না বিশ্বের জনবহুল প্রায় সব শহরের কোনোটাতেই রিকশা চলে না। তাহলে তারা কি ঘরেই বসে থাকে? এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের একদা বৃহত্তম শহর কলকাতায়ও রিকশা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে আমাদের মাইন্ডসেট বদলাতে না পারার কারণে আমরা ডিজিটাল কেন, কোনো কালেই উন্নয়নের আশা করতে পারি না। যানজটের জন্য রিকশা এককভাবে দায়ী নয় এ কথা স্বীকার করলেও রিকশা যে রাজধানীর রাস্তায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির একটা মস্ত বড় কারণ এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই শহরে লাখ লাখ রিকশা কোনো রকম ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে যে যেদিকে পারছে রিকশা চালাচ্ছে, এটা তো খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। এই রিকশাচালকরা ট্রাফিক নিয়ম কী তাই জানে না। এখন তো এমন অবস্থা যে, সব রাস্তা যদি কেবল রিকশার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয় তবু্ও রাস্তায় জট লেগে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার এ কথার সঙ্গে একমত যে, কেবল রিকশাই যানজটের কারণ নয়। সেসঙ্গে এটাও ঠিক যে, রিকশা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে রোগাক্রান্ত করে তুলেছে। পাশের দেশের কলকাতায় তিন-চার কিলোমিটার রাস্তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দিব্যি হেঁটে চলাচল করছে। ফলে তারা অপেক্ষাকৃত কম রোগাক্রান্ত হচ্ছে। আজকাল ডাক্তার সাহেবরাই বলে থাকেন, শারীরিক সুস্থতার জন্য হাঁটার উপকারিতা কত বেশি। এক-দেড় কিলোমিটার হাঁটতেও আমাদের অনীহা। এটা আমাদের স্বাস্থ্যরক্ষায় যে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এ কথা সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন যে কোনো মানুষই স্বীকার করবেন। হ্যাঁ, আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় রিকশা হয়তো একেবারে উঠিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে তা শহরের লেনগুলোতে চলতে তো কোনো অসুবিধে নেই। এর সমাধান কী ভাবে হতে পারে পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহর থেকে আমরা সে অভিজ্ঞতা নিতে পারি।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, যে শহরের রাস্তা বড়জোর দুই থেকে আড়াই লাখ গাড়ি চলাচলের জন্য উপযোগী সেই রাস্তায় যদি পাঁচ-ছয় লাখ গাড়ি নামানো হয় তবে যানজট ঠেকায় কার সাধ্য। এ জন্য আমাদের ট্রাফিক বিভাগ ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শী ও অপরিণামদর্শী কর্মকর্তারা দায়ী নিঃসন্দেহে। এছাড়া জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও কম দায়ী নয়। যেখানে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট অবশ্যম্ভাবী, সেখানে সব প্রাইভেট গাড়ি সিএনজি করার তুঘলকি চিন্তা কর্তাব্যক্তিদের মাথায় আসে কী ভাবে তা ভেবে পাওয়া দুষ্কর। তদুপরি প্রাইভেট কারের জন্য সিএনজির দাম কম করে হলেও পেট্রোলের দামের অন্তত ৬০- ৭০% বেশি রাখা উচিত ছিল। তা না করে যে কত বড় ভুল হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ জোড় নম্বরের গাড়ি, একদিন বেজোড় নম্বরের গাড়ি, আরেকদিন বন্ধ রাখার তুঘলকি পরিকল্পনা কারও কারও মাথায় ঘুরছে। উচিত হচ্ছে কেবল পাবলিক ট্রান্সপোর্টই সিএনজিতে চলবে_ এই নীতি কার্যকর করা। সবচেয়ে বড় কথা, আরামদায়ক পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত করা। এটা করা কোনো কঠিন ব্যাপার ছিল না। একটু বুদ্ধি খাটালেই সেটা যে সম্ভব তা কারও মাথায় যেন আসে না। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক_ গুলিস্তান-আবদুল্লাহপুর রুটে রাস্তার মাঝ দিয়ে যে লাইটপোস্টগুলো আছে তার উভয় পাশে যদি লাইট রেল ট্র্যাক বসানো হয় উভয় পাশে ডিভাইডার দিয়ে এবং তার ওপর এমআরটি বা এলআরটি কমিউটার ট্রেন চালু করা হয় তবে কেবল লাইন বসানো ও ডিভাইডার তৈরি ছাড়া আর কোনো খরচ নেই বললেই চলে। ডিভাইডারগুলো বর্তমানের চেয়ে কেবল ফুটখানেক উঁচু করে তৈরি করতে হবে। একইভাবে গুলিস্তান-গাবতলী, গুলিস্তান-পল্লবী, গুলিস্তান-গাবতলী বা গুলিস্তান-কাঁচপুর রুটও চালু করা সম্ভব। এতে রাস্তায় দুর্ঘটনার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা বলার জন্যই বলি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ, কিন্তু অপব্যয়ের বেলায় আমাদের হুঁশ থাকে না। স্কাই রেল, মেট্রো রেল প্রভৃতি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, যা কেবল বিপুল ব্যয়বহুলই নয়, দীর্ঘ সময়সাপেক্ষও বটে; সেদিকেই পণ্ডশ্রম চালিয়ে যাচ্ছি। যে সরকার আজ আড়াই বছরের মধ্যে মেইন রুটগুলোতে ভাঙাচোরা, আউটডেটেড ক্ষুদ্র যানবাহন উঠিয়ে রাস্তায় ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে পারল না; পাবলিকের সুবিধার জন্য যথেষ্ঠসংখ্যক আরামদায়ক বড় বডি বা ডাবল ডেকার বাসই নামাতে পারল না তারা মেট্রো রেল, স্কাই রেল প্রভৃতির স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে হয়তো কয়েকটি সরকার আবার গত হয়ে যাবে, তখনও হয়তো আমরা স্বপ্ন দেখতেই থাকব।

No comments

Powered by Blogger.