হাল ছাড়েননি যিনি by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

‘ছোট্ট খুকি কাঁদছ কেন, মুখটি কেন ভারী/মা বকেছে তাই কি দেয় মায়ের সাথে আড়ি।’ আধো আধো বোলে ছড়াগানটি করছিল শিশির। অথচ কয়েক বছর আগে শিশুটি কোনো কথাই বলতে পারত না। কল্পনা রায় ভৌমিকের সন্তানেরা এ রকমই কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না, কেউ শুনতে পেত না, কেউ বলতে পারত না, ঘাড় কাত করে তাকাত,


কারও মুখ দিয়ে লালা ঝরত—তাদের এসব প্রতিবন্ধিতা জয় করেই তিনি তাদের জননীর আসন অধিকার করেছেন। তারা এখন শুনতে পায়, বলতে পারে, খেলতে পারে, প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, বিদেশে যায়, মেডেল নিয়ে আসে। ৩০ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কল্পনা রায় ভৌমিক এ জায়গায় এসেছেন।
কল্পনা রায় ভৌমিক মাস্টার্স পাস করেন ১৯৭৯ সালে। তখনই সুযোগ পেয়েছিলেন সরকারি কলেজে শিক্ষকতার। করেননি। মোটা বেতনে চাকরির সুযোগ হয়েছিল একটি বেসরকারি সংস্থায়। তা-ও করেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। হিসাব করে বের করেন, মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অসহায় হচ্ছে প্রতিবন্ধীরা। আজ থেকে ৩০ বছর আগে তার চোখে এই নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তাসকিনা ফারুক। তিনি প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি বিদ্যালয় খুলে দেন। বিদ্যালয়টি পরিচালনা করার জন্য ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ের একটি কার্যনির্বাহী কমিটি আছে—সুইড সোসাইটি ফর দ্য ইনটেলেকচুয়ালি ডিসঅ্যাবল্ড। কল্পনা রায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক হলেন। সুইড পরিচালিত হলেও বিদ্যালয়ের তহবিল বা টাকা-পয়সা কিছুই ছিল না। শুধু তাসকিনা ফারুক তাঁর হাতে একটা চটের ব্যাগ, একটি খাতা ও একটি কলম তুলে দিয়েছিলেন। কল্পনা রায় এটাকেই গুরুদায়িত্বভার হিসেবে গ্রহণ করেন। সেই হলো শুরু।
কল্পনা রায় বলেন, ঘরভাড়া দেওয়ার টাকা-পয়সা নেই। তাই রাজশাহী নগরের খাদেমুল ইসলাম উচ্চবিদ্যালয়ের একটি কক্ষে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলো ১৯৮২ সালে। সহকারী শিক্ষক হিসেবে পেলেন ফেরদৌস আরাকে। এক মাস পর রাজশাহী মহিলা শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাঁদের একটা কক্ষ ব্যবহার করার অনুমতি দিল। কিন্তু ক্লাস করার জায়গার ব্যবস্থা করার চেয়ে কঠিন কাজ ছিল ছাত্রছাত্রী জোগাড় করা। তখন প্রতিবন্ধীদের পাগল হিসেবে গণ্য করা হতো। কোনো পরিবারে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে থাকলে তারা এটা তাদের পাপ বলে মনে করত। লেখাপড়া শেখানোর জন্য চাইতে গেলেও তারা লুকিয়ে রাখত। শিক্ষকদের অপমান করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলত। বারবার তাদের কাছে গিয়ে পাপ নয়, প্রতিবন্ধী সন্তান হওয়ার পেছনে চিকিৎসাশাস্ত্রে অন্য কারণ রয়েছে—এসব বুঝিয়ে চার মাসে ১৫ জন শিক্ষার্থীর ব্যবস্থা হলো। ওই বছরই অক্সফামের একটি প্রতিনিধিদল রাজশাহী মহিলা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে আসে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়ের কার্যক্রম অক্সফামের কান্ট্রি ডিরেক্টরের নজরে পড়ে। তিনি এ বিষয়ে কল্পনা রায়ের সঙ্গে কথা বলে খুব খুশি হলেন। তিনি এই বিদ্যালয়ে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিলেন। তা দিয়ে নগরের সিপাইপাড়ায় একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হলো। কিছু আসবাব কেনা হলো। বলতে গেলে এখানেই নিজেদের মতো করে চালু হয় রাজশাহী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়।
কল্পনা রায় বলেন, কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। প্রথম প্রথম তাদের উন্নতির জন্য কিছুই করতে পারতেন না। শুধু বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড দিয়ে তাদের উন্নতির জন্য চেষ্টা করেছেন। এরপর ঢাকায় সুইড অফিসে এনএফপিইউর বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মিস লেনা রেক্টারের কাছে তাঁর প্রশিক্ষণে হাতেখড়ি হলো। এর পরের বছর নেপালে পাঁচ সপ্তাহের জন্য একটি প্রশিক্ষণের সুযোগ হয়। কিন্তু তখন এখানে শিক্ষকদের কোনো বেতন-ভাতা ছিল না। হাতখরচ হিসেবে দু-এক শ টাকা দেওয়া হতো। শুধু নেশার কারণে, না হলে এই কাজে কারও লেগে থাকা সম্ভব নয়। এসব বিবেচনা করে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও ফেরদৌস আরা ব্যাংকের চাকরি নিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। এরপর আরও অনেক শিক্ষক যোগ দিয়েছেন, কিন্তু একই কারণে তাঁরাও চলে যান।
ইতিমধ্যে আরও দুবার বাড়ি বদলে নগরের আহম্মদপুরে বর্তমান ঠিকানায় নিয়ে আসা হয়েছে। ছাত্রসংখ্যাও বেড়ে গেছে। এ সময় বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালানোর খরচ দিয়েছে এনএফপিইউ। ২০০০ সাল থেকে তারাও আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়। এবার বিদ্যালয়টি নিয়ে কল্পনা রায় যেন ভেসে বেড়াতে লাগলেন। এ সময় বিদ্যালয়ের বর্তমান বাড়িটির মালিক মঞ্জুরা মমতাজ তাঁর পাশে দাঁড়ান। তিনি তাঁর নিজের বাড়ির নিচতলা বিদ্যালয়ের জন্য ছেড়ে দিলেন এবং আশ্বাস দিলেন, যত দিন টাকার জোগাড় না হয়, তত দিন তাঁকে ভাড়া দিতে হবে না। তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন প্রবাসী মোস্তাক আহাম্মদ। তিনি এখন পর্যন্ত প্রতি মাসে চার হাজার টাকা করে বাড়িভাড়া বহন করে যাচ্ছেন। চার বছর ধরে সপুরা সিল্ক লিমিটেডের মালিক সদর আলী তাঁদের আরও একটি কক্ষের ভাড়া বহন করছেন। জীবনের ৩০টি বছর পার করে দেওয়ার পর গত বছর তিনি যেন তীরহারা ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়ে উঠেছেন। সরকার প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের বেতন দিতে শুরু করেছে। আর শিক্ষকেরও সংকট নেই।
এখন শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা আটজন। বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী এখন ৫০ জন। গৃহভিত্তিক শিক্ষার্থী আছে ৬০ জন। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর সঙ্গে ভয়েসথেরাপি ও ফিজিওথেরাপি দেওয়া হয়। এতে করে যারা কথা বলতে পারত না, তারা এখন কথা বলতে পারে। তারা খেলাধুলা, নাচগান, আবৃত্তি ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। এ বিষয়েও তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারা দেশে ও দেশের বাইরে অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। প্রতিবছর ঢাকায় সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার নিয়ে আসছে। গত জুনে এই বিদ্যালয়ের ছাত্র হামীম আবদুল্লাহ ও ইয়াসিন আলী গ্রিসে স্পেশাল অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়। সেখানে বাংলাদেশ স্পেনকে ১১ গোলে পরাজিত করেছে। দলের হয়ে হামীম ও ইয়াসিন দুজনই স্বর্ণপদক পেয়েছে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ থেকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের একটি দল চীনের সাংহাইতে যায়। সে দলে রাজশাহী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ছিল। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেজাউনুল হক ৪০০ মিটার রিলে রেসে অংশ নিয়ে ব্রোঞ্জপদক পায়।
সম্প্রতি বিদ্যালয়ে গিয়ে কল্পনা রায়ের সেই মমতামাখা পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হতে হয়। বাচ্চাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে নিজেও গাইছেন ছড়াগান। চার বছর আগে শিক্ষার্থী অপর্ণা সরকার কোনো কথাই বলতে পরত না। সে আমাদের ‘কাজলা দিদি’ আবৃত্তি করে শোনাল। ২০১০ সালে ঢাকায় জাতীয় প্রতিযোগিতায় আবৃত্তিতে সে পুরস্কার পেয়েছে। বিদ্যালয়ের সভাপতি মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি জানি না কল্পনা রায় বাচ্চাদের কী দিয়েছেন, কিসের টানে বাচ্চারা বিদ্যালয়ে ছুটে যায়। হয়তো বাড়ির মেয়েরাও এতটা পারে না। গাড়ি আসতে দেরি হলে বাচ্চারা ঠিক থাকতে পারে না। হেঁটেই চলে যেতে চায়।’ কল্পনা রায়ের স্বামী কানাইলাল রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা (সংস্কৃত) বিভাগের শিক্ষক হিসেবে গত বছর অবসর নিয়েছেন। কল্পনা রায়ের এই যাত্রায় তিনি ছিলেন পাশেই। মোশাররফ হোসেন বলেন, তাঁর অবদানও স্বীকার করতে হয়। তিনি তাঁর নিজের বাচ্চাদের পাশে কল্পনাকে পাননি। যখন বাচ্চাদের পরীক্ষা, তখন হয়তো কল্পনা প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকায় রয়েছেন। এ নিয়ে জীবনে তাঁর কোনো অনুযোগ ছিল না।
এই বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র তৌহিদ হাসান এখন ব্যবসা করছেন। তাঁর একটি দোকান আছে। বিয়ে করেছেন। ফুটফুটে একটি মেয়ে হয়েছে। তিনি স্বনির্ভর ও সুখী দাম্পত্য জীবনযাপন করছেন। বিদ্যালয়ের ছাত্র নূর ই কবীর সিফা এখন রাজশাহী সিটি করপোরেশনে চাকরি করছেন। আরিফুল ইসলাম রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে চাকরি করছেন। আমানুল্লাহ শিমুল বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি বিয়ে করেছেন। তাঁরও একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। বলতে বলতে কল্পনা রায়ের চোখেমুখে ফুটে ওঠে খুশির ঝিলিক।

No comments

Powered by Blogger.