বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের শর্ত-নিশ্চিত করতে হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা

স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে কতটুকু স্বাধীন হতে পেরেছে- এমন একটি প্রশ্ন হুট করে কেউ করে ফেললে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এটাই যে এই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, তা অস্বীকার করারও উপায় নেই। একাত্তরে আমরা রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি।
কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আজও আসেনি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে একটি জাতি কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। দেশের অর্থনীতি মজবুত করতে গিয়ে অনেক সময় বিদেশি ঋণের প্রয়োজন হয়। সেই বিদেশি ঋণ নিতে গিয়ে হাত পাততে হয় বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছে। দাতা সংস্থাগুলো এই সুযোগ নিয়ে থাকে। সাহায্যের নামে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরোপ করে কঠিন শর্ত। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে এর বিকল্প হাতে থাকে না। দাতা সংস্থার শর্ত মানতে গিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে শর্তের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হয়। সংস্কারসহ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানামুখী শর্ত মেনে নিতে হয়। এই শর্তের চাপ গিয়ে পড়ে ভোক্তা পর্যায়ে, সাধারণ মানুষের ওপর। এখন যেমন ভর্তুকি প্রত্যাহারের চাপ সইতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংককে যতই আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বলা হোক না কেন, আসলে দুটি সংস্থাই নিজেদের তহবিল বৃদ্ধির ব্যবসা করে। এই ব্যবসা করতে গিয়ে দরিদ্রতর দেশগুলোকে উন্নয়নের ফাঁদে ফেলা হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের এই ফাঁদ পাতা আছে। তাঁদের 'ইকোনমিক হিটম্যান' ছড়ানো আছে বিশ্বজুড়ে। যেকোনো দেশে কেমন করে ঋণ দেওয়া হবে বা সেই দেশকে কেমন করে ঋণের ফাঁদে ফেলা হবে, তার ছক আগে থেকেই তৈরি করা থাকে। দেশভেদে ছক বদলে দেওয়া হয়। কালের কণ্ঠে তিন দিন ধরে প্রকাশিত ধারাবাহিক প্রতিবেদনে সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বব্যাংকেরই সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী জোসেফ ই স্টিগলিজের উদ্ধৃতি। তিনি বলেছেন, 'আইএমএফের অর্থনীতিবিদদের সব কিছুই গোপন। তাঁরা চান না বহিরাগতরা তাঁদের কাজ নিয়ে কিছু বলুক। বাইরে তাঁরা খোলামেলা নীতির কথা বললেও নিজেরা দরকষাকষি করেন গোপনে। কোনো একটি দেশে গিয়ে পাঁচতারা হোটেলে থেকে কয়েক দিন বা সপ্তাহের মধ্যেই সে দেশের জন্য তাঁরা একটি কর্মসূচি তৈরি করে ফেলেন, যা ওই দেশের মৌলিক চাহিদা বা আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোনো দেশভিত্তিক আইএমএফ টিম আগে থেকেই কর্মসূচির খসড়া তৈরি করে রেখেছে কিংবা এক দেশের প্রোগ্রাম হুবহু অন্য দেশের জন্য চালিয়ে দিয়েছে- এমন নজিরও আছে।'
বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের ঋণের জালে জড়িয়ে দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি এ দুই সংস্থার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার উদাহরণও আছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শ ত্যাগ করার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে এ দুই সংস্থার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা দেশের অর্থনীতি। রক্ষা পেয়েছে তাদের জাতীয় ও খনিজ সম্পদ। বেড়েছে প্রবৃদ্ধি, সামাজিক খাতে ব্যয় বেড়েছে, ব্যাপক হারে কমেছে দারিদ্র্য।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নানা বাহানার পর এ দুই সংস্থার কার্যক্রম দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বাংলাদেশের এখন কী করা উচিত? অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশকে এখন থেকেই ধীরে ধীরে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। তবে অর্থনৈতিক মুক্তির নতুন পথে চলতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন রাজনৈতিক সততা। সেখানে বাংলাদেশ নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারলেই অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব। বিশ্বের অন্যান্য দেশ পারলে বাংলাদেশও পারবে।

No comments

Powered by Blogger.