ধর্ম-সমাজে সহমর্মিতা প্রকাশে রোজার ভূমিকা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজানে সিয়াম সাধনা বা রোজাব্রত পালন সমাজে সাহায্য-সহযোগিতা, সমবেদনা তথা সহমর্মিতা প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম। সমাজজীবনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য ঝগড়া-বিবাদ, ফিতনা-ফ্যাসাদ, মারামারি, অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার-জুলুম, নির্যাতন-পাপাচার, খুন-খারাবি প্রভৃতি অনৈসলামিক আচরণ।


মাহে রমজানে প্রকৃত রোজাদার ও ঈমানদার ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা সব সময়ই এসব অসৎ কাজকর্ম থেকে দূরে থেকে বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের প্রতি পারস্পরিক সহানুভূতি প্রকাশ করেন।
মাহে রমজান সামাজিক ঐক্য ও নিরাপত্তা বিধানে এবং একটি সংঘাতমুক্ত গঠনমূলক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কারণ রমজান মাসের মধ্যে সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক—এ তিন প্রকারের মাহাত্ম্য বিদ্যমান। সুতরাং মাহে রমজানের রোজার ধর্মীয় গুরুত্বের মতো সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। বিশেষ করে সমাজে রোজাদারদের পারস্পরিক সমবেদনা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে রমজান মাসের রোজার ভূমিকা অপরিসীম।
সমাজে ধনী-গরিব, দুঃখী-বুভুক্ষু, অনাথ-এতিম—বিভিন্ন ধরনের মানুষ বসবাস করে। রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার পরিহার করার ফলে গরিব-দুঃখীদের অপরিমেয় দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে শেখেন। এভাবে মাহে রমজানে ধনী লোকেরা অতি সহজেই সমাজের অসহায় গরিব-দুঃখী, এতিম-মিসকিন ও নিরন্ন মানুষের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে তাঁদের জন্য সেহির ও ইফতারের ব্যবস্থা করেন এবং তাঁদের দান-খয়রাত, জাকাত-সাদকা প্রদানসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘এ মাস (রমজান) সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস।’ (মিশকাত)
সমাজে মানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মাহে রমজানের রোজার যথেষ্ট গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। মুসলমান পরস্পর একে অপরের ভাই। মানুষে মানুষে যে সম-অধিকার রয়েছে, প্রকৃত রোজাদার ব্যক্তি তা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন এবং সমাজের সব মানুষের প্রতি খুবই সদয় ব্যবহার করেন। কারও প্রতি বিন্দুমাত্র অসদাচরণ ও অন্যায়-অপরাধ করেন না। রোজাদার ব্যক্তি সবাই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সাম্যের জয়ধ্বনি করেন। মাহে রমজানের দিনে অধীনস্থ শ্রমিক, কর্মচারী এবং চাকর-বাকরদের দায়িত্ব ও কাজকর্ম হালকা করে দেওয়া উচিত। এ মাসে তাদের ওপর কষ্টকর সাধ্যাতীত কাজের বোঝা চাপানো সম্পূর্ণ অনুুচিত—এটা অমানবিক বটে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘এ মাসে (রমজানে) যারা দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করে, অর্থাৎ তাদের কাজের বোঝা হালকা করে দেয়, আল্লাহ তাদের দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন।’
রমজান মাসে কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তিরা অপরের বদনাম ও কূটনামি থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা সকল প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, ফিতনা-ফ্যাসাদ, অযথা বাগিবতণ্ডা ও যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকেন। তাঁদের মুখ থেকে কোনো প্রকার অশ্লীল কথা বের হয় না। যদি কোনো রোজাদার লোককে কেউ গালিগালাজ ও ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করতে চায়, তখন সেই রোজাদার যদি উত্তেজিত না হয়ে ঝগড়া-বিবাদ ও গালিগালাজ থেকে দূরে সরে যান, তাহলে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় না এবং একটি আদর্শ নৈতিকতাপূর্ণ সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠে।
মাহে রমজানে সমাজের স্থিতিশীলতা, শান্তি, সমপ্রীতি ও নিরাপত্তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিদ্যমান। সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি মাহে রমজানের মতো অন্যান্য মাসেও আত্মসংযমের সঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সব ধরনের বিরোধ এড়িয়ে যান, তাহলে কোনোরূপ সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। তাই সমাজ জীবনে পরস্পরের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এবং সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ক্ষেত্রে রোজার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
মাহে রমজানে সহমর্মিতা প্রকাশে ইসলামের সুমহান শিক্ষা অনায়াসে গ্রহণ করে মুসলমানদের সমাজজীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষ করে রোজা রাখা অবস্থায় রোজাদারের মনে তার অন্যান্য ভাইয়ের প্রতি খুব বেশি পরিমাণে সহানুভূতি থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ, নিজে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হওয়ার দরুন খুব ভালো করেই অনুভব করতে পারেন যে আল্লাহর গরিব-অসহায় বান্দারা দুঃখ-কষ্ট ও অভাব-দারিদ্র্যে কীভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে; অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এ মাস অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশের মাস। তাই মাহে রমজানে দরিদ্রদের প্রতি ধনীদের সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশ করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। নিজের পরিবারে সেহির ও ইফতারের জন্য যে ব্যয়বহুল আয়োজন করা হয়, এতে সমাজের অসহায় পাড়া-প্রতিবেশীদের জন্যও যেন কিছু অংশ রাখা হয় এবং হতদরিদ্রদের তা পৌঁছানো হয়, গরিবরাও যেন তৃপ্তির সঙ্গে সেহির খেয়ে রোজা রাখতে পারে এবং সারা দিন রোজার পর পরিতৃপ্তির সঙ্গে ইফতার করতে পারে। এমনিভাবে গরিবদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়ানো দরকার। এ ছাড়া সারা বছরই হতদরিদ্র ও আর্তমানবতার প্রতি সমবেদনা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ মাহে রমজানের শিক্ষা।
রোজাদারদের সম্মিলিত সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতা অনেক অসহায় মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে। ফলে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কশাঘাতে নিপতিত অনেক অনাহারী মানুষ ক্ষুধা-তৃষ্ণার অসহনীয় দুর্ভোগ থেকেও মুক্তি পাবে। মাহে রমজান যেন সমাজের ধনী-গরিব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা গড়ে ওঠার অবলম্ব্বন হয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.