কল্পকথার গল্প-তেমন কি আর ঘটবে কোনো দিন? by আলী হাবিব

চক্ষু চড়কগাছ বলে একটা কথা আছে। দুটি খবর পাঠ করে ঠিক সে রকমই হওয়ার জোগাড়। এও কি সম্ভব! খবরেও ঠিক সে রকমই বলা হয়েছে। এও কি সম্ভব_এমন প্রশ্ন করা হয়েছে। দুটি খবর পড়ে অনেক আগের দুটি গল্প মনে পড়ে গেল। একটি গল্প চালু ছিল ঢাকার সিনেমার জগৎ নিয়ে।


সে গল্পটি একটু অদল-বদল করে পরে চালানো হয় বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। গেল শতকের সত্তরের দশকের শেষার্ধে ও আশির দশকের প্রথমার্ধের গল্প। তখন রাজনৈতিক নেতা কেনাবেচার কালচার চালু ছিল। তো সেই গল্পটিই আগে বলা যাক। গল্পের চরিত্র মাত্র দুটি। একজন ডাক্তার। অন্যজন রাজনৈতিক নেতা। এই ঢাকা শহরে কোনো এক চিকিৎসক মানুষের ব্রেইন আপগ্রেড বা উন্নত করে দিতে পারতেন। বেশ ভালো পসার ছিল ভদ্রলোকের। অনেকের ব্রেইন তিনি বদলে দিয়েছেন। তাঁরা বেশ জমিয়ে দুনিয়াদারি করে খাচ্ছিলেন। এক রাজনৈতিক নেতা কোনোভাবেই কল্কে না পেয়ে একদিন ওই চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে হাজির। চিকিৎসকের ওয়েটিং রুমে অনেক রোগীর ভিড়। একসময় তাঁর ডাক পড়ল। তিনি চিকিৎসকের সামনে গিয়ে বসলেন। চিকিৎসক তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, তিনি কী চান। ভদ্রলোক তাঁর দুঃখের কথা খুলে বললেন। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। নিজের একটি বাড়ি হলো না ঢাকা শহরে। ভাড়া বাড়িতে থাকেন। মাস শেষে অনেক সময় ভাড়া দিতে পারেন না। বাড়িওয়ালার গঞ্জনা সইতে হয়। ঘরে স্ত্রীর গঞ্জনা তো আছেই। ছেলেমেয়েদের শখ মেটাতে পারেন না। জীবন তাঁর কাছে মূল্যহীন। কোনো উপায় না দেখে চিকিৎসকের কাছে এসেছেন। যদি একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর ব্রেইন আপগ্রেড করে দিলে যদি তিনি একটা কিছু করতে পারেন_এই ভেবেই চিকিৎসকের কাছে এসেছেন তিনি। ভদ্রলোককে জানানো হলো, ব্রেইন আপগ্রেড করতে হলে তাঁর মাথা থেকে মস্তিষ্ক খুলে রাখতে হবে। চিকিৎসকের ল্যাবরেটরিতে এটা আপগ্রেড করা হবে। এর জন্য সময় দিতে হবে এক মাস। এই এক মাস তিনি বাইরে কোথাও যেতে পারবেন না। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। ভদ্রলোক রাজি হলেন। তাঁর মস্তিষ্ক খুলে রাখা হলো। মস্তিষ্কবিহীন মাথা নিয়ে ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। এরপর ভদ্রলোকের আর দেখা নেই। চিকিৎসক তো চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভদ্রলোকের মাথায় তো কোনো মগজ নেই। এ অবস্থায় কোথায় কী করে বেড়াচ্ছেন কে জানে! এক মাস গিয়ে ছয় মাসে গড়াল। ভদ্রলোকের দেখা নেই। এমনটি আগে কখনো হয়নি। এর আগে যাঁরাই ব্রেইন আপগ্রেড করতে এসেছেন, সবাই ঠিক সময়ে এসে তাঁদের ব্রেইন আবার নতুন করে লাগিয়ে গেছেন। এই ভদ্রলোকই ব্যতিক্রম। চিকিৎসক রোজ তাঁর চেম্বারে যাওয়া-আসার পথে রাস্তায় মানুষের ভিড়ে এই রাজনৈতিক নেতাকে খোঁজেন। একদিন তিনি পথ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখেন একটি জনসভা হচ্ছে। আর সেই জনসভায় বক্তৃতা করছেন তাঁর রোগী সেই রাজনৈতিক নেতা। চিকিৎসক তাঁর ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ি থেকে নেমে জনসভার এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। একসময় জনসভা শেষ হলো। ভদ্রলোক মঞ্চ থেকে নামলেন। চিকিৎসক তাঁর পিছু নিলেন। নেতা হাল আমলের বেশ বড় দামি গাড়িতে উঠতে যাবেন, তখনই চিকিৎসক গিয়ে ধরলেন তাঁকে। নেতাটি চিকিৎসককে চিনতে পারলেন। চিকিৎসক জানতে চাইলেন, কেন তিনি তাঁর আপগ্রেড করা ব্রেইন নিয়ে আসছেন না? নেতা জানালেন, ব্রেইন খুলে রেখে আসার পর তিনি বেশ ভালো একটা অফার পেয়ে যান। অফার লুফে নিতে তিনি ভুল করেননি। এখন তিনি বড় মাপের নেতা। তিনি ঢাকায় বাড়ি করে ফেলেছেন। বউয়ের গঞ্জনা সইতে হয় না। বেশ ভালো আছেন। গাড়ি হয়েছে, বাড়ি হয়েছে। টাকারও কমতি নেই। যা চেয়েছিলেন, সব পেয়েছেন তিনি। ব্রেইন যখন মাথায় ছিল, তখনো তাঁর কাছে অনেক অফার এসেছিল, কিন্তু তিনি সেসব অফার নেননি। মাথায় ব্রেইন না থাকতেই যদি এভাবে সব কিছু পাওয়া যায়, তাহলে আর ব্রেইন দিয়ে কী হবে! কাজেই আপগ্রেড করা ব্রেইন দিয়ে তাঁর আর দরকার নেই। হতাশ চিকিৎসক চলে গেলেন নিজের চেম্বারে।
গল্পটি মনে পড়ল, কৃত্রিম মস্তিষ্ক সম্পর্কিত খবরটি পড়ে। অবিশ্বাস্য খবর। কৃত্রিম মস্তিষ্কের জন্য আর বেশি দিন নাকি অপেক্ষা করতে হবে না। বাজারেই নাকি পাওয়া যাবে মস্তিষ্ক। যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ভিটারবি স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষকরা ল্যাবরেটরিতে নাকি এমন একটি জৈব যৌগ তৈরি করেছেন, যা মস্তিষ্কের কোষের মতোই কাজ করতে পারে। আর এ আবিষ্কার জাগিয়েছে নতুন আশা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ আবিষ্কারের পথ ধরেই একদিন তৈরি হবে কৃত্রিম মস্তিষ্ক। খবরে আরো বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এমন এক ধরনের যৌগ সিনথেটিক সার্কিট তৈরি করেছেন, যার আচরণ অনেকটা মানুষের মস্তিষ্কের কোষের মতো। এর মধ্য দিয়ে নিউরন বৈদ্যুতিক বা রাসায়নিক সংকেত আদান-প্রদান করতে পারে। পরেরই আরেকটি খবর তো আরো রোমাঞ্চকর। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলা যাবে দুঃসহ স্মৃতি। অর্থাৎ রবিঠাকুরের গানের কথার মতো আমাদের মস্তিষ্ক ভরা থাকবে যে স্মৃতিসুধায়, সে স্মৃতি দুঃখের নয়, সুখের। আহা! আর, এমনটা যদি হয়, তাহলে তো শোনা সেই গল্পটিই সত্যি হতে যাচ্ছে!
দ্বিতীয় গল্পটি বলার আগে দ্বিতীয় খবর। এ খবরটি মরিচ নিয়ে। কোন মরিচে কত ঝাল, সেটা আমাদের সবারই তো জানা। সবাই না বললেও আমরা অনেকেই জানি যে আমাদের কার কার স্ত্রীর মুখের কথার ঝাল মরিচের চেয়েও বেশি। মাঝে-মধ্যে খবরের কাগজে খবরের শিরোনাম হয় মরিচ। কাঁচা বা শুকনো মরিচের দামে কত ঝাল সেটাই থাকে খবরে। কিন্তু সেই মরিচ নিয়ে এবার অন্য রকম একটি খবর। সুস্থ দেহ ও প্রশান্ত মনের জন্যও নাকি মরিচ অপরিহার্য। একটু খোলাসা করেই খবরটি বলা যাক। কর্মব্যস্ত থাকতে হলে চাই সুস্থ দেহ ও প্রশান্ত মন। কিন্তু শরীর সায় দেয় না অনেককেই। তাঁদের কেউ কেউ নেমে পড়েন ঘাম ঝরানোর চেষ্টায়। নিয়মিত ব্যায়াম করেও হয়তো কাঙ্ক্ষিত শরীর পান না। কেউ আবার খাবার গ্রহণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ওজন কমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ করাটা অনেকের জন্যই কঠিন। পেটুক স্বভাবের এসব মানুষের জন্য একটি সহজ সমাধান নাকি খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। রাতের খাবারে নিয়মিত মরিচ খেলেই নাকি উপকার পাওয়া যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের পুর্দো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তাঁদের গবেষণায় দেখেছেন, মরিচের মধ্যে ক্যাপসায়াসিন নামে যে উপাদান রয়েছে তা-ই মরিচকে ঝাল করে। আর মরিচের এ উপাদান মানুষের ক্ষুধা কমায় এবং শক্তিক্ষয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তবে এ ক্ষেত্রে গুঁড়ো বা বাটা মরিচ নয়, টুকরো করা মরিচ খেতে হবে। এর ফলে খাবার গ্রহণের চাহিদা কমে। এভাবে জিহ্বা নিয়ন্ত্রণের ফলে ওজন কমে আসবে। যাঁরা মসলাযুক্ত খাবার বেশি পছন্দ করেন, তাঁরা প্রতিদিনের খাবারে লাল মরিচ টুকরো ছিটিয়ে দিতে পারেন। মরিচ ক্ষুধা দমন করে এবং ক্যালরি পোড়ায়।
এবার দ্বিতীয় গল্পটি বলা যাক। এটাও রাজনৈতিক নেতাদের গল্প। প্রথম গল্পটির সঙ্গে এ গল্পটি সম্পর্কিত। চিকিৎসক তাঁর রোগীকে দেখেছিলেন জনসভায় বক্তৃতা দিতে। একনাগাড়ে ভদ্রলোক অনেক কথাই বলে যাচ্ছিলেন। অনেক কথাই অর্থহীন, কেবলই কথার কথা। অনেক কথা রীতিমতো কুরুচিকর। অনেক কথা অন্য রাজনৈতিক দল ও নেতাদের উদ্দেশ করে বলা। সেসব কথাও যেমন অযৌক্তিক, তেমন কেবলই কথার কথা। রাজনীতির মঞ্চ গরম করার জন্য এমন কথা অনেকেই বলে থাকেন। চিকিৎসক নেতার বক্তৃতা শুনতে শুনতে ভাবছিলেন, এসব অযৌক্তিক কথা কেন যে এঁরা বলেন! মরিচের খবর পড়ে তেমন চিন্তা ঢুকেছে মাথায়। আচ্ছা, এমন কিছু কী পাওয়া সম্ভব, যা খেলে নেতাদের অতিরিক্ত কথা বলা ও বাগাড়ম্বর কমে যাবে? মরিচে যেমন খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ হবে, তেমনি যদি কোনো কিছুতে কথা বলার ক্ষেত্রে জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ করা যেত! বেশ হতো, তাই না? কিন্তু তেমন কি আর ঘটবে কোনো দিন?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.