অসলো সামার স্কুল-নানা রঙের মেলা by তারেক মাহমুদ

বাংলাদেশে তাপমাত্রা কখনও শূন্য ডিগ্রির নিচে নামে না—এ কথা শুনে তো অবাক রাশিয়ার মেয়ে ইরিনা সুতোভা ‘ইস, তোমার দেশ কত সুন্দর! আমি অবশ্যই যাব তোমার দেশ দেখতে।’ ইরিনার আগ্রহে আরও বাড়তি মাত্রা যোগ করল সুইডেনের মেয়ে সোফি রসভেল। সে বলল, ‘আমি একবার বাংলাদেশে চার দিন ছিলাম।


খুব সুন্দর একটা দেশ এবং ওখানকার মানুষগুলো খুবই অতিথিপরায়ণ।’ ইউক্রেন থেকে আসা উলিয়ানা প্রসকুনিনা জানাল, ‘আমাদের দেশে শীতের তীব্রতা বেশি। সারা বছর ধরে আমরা গরমের দুই-তিনটা মাসের জন্য অপেক্ষা করি। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি নতুন দেশ ও তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে এবং গরমকাল উপভোগ করতে আমি চলে এসেছি এই সামার স্কুলে।’
বলছিলাম নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আয়োজিত সামার স্কুলের কথা। এই সামার স্কুলে শতভাগ বৃত্তি পেয়ে আমারও অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ৪৫টি দেশের ৯৪ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন এবারের সামার স্কুলে। জুলাইয়ের তিন সপ্তাহব্যাপী এই প্রোগ্রামের মূল বিষয়গুলো ছিল: গ্লোবালাইজেশন, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইস্যুজ অব ইন্টারকালচারাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং। সামার স্কুলের এই প্রোগ্রামকে শুধু পড়া বললে ভুল হবে, এটা আসলে সারা বিশ্ব সম্পর্কে জানা ও নিজেকে জানানোর একটি কোর্স। কারণ, সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা হলো এই সামার কোর্স। এই কোর্সের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের অন্য দেশের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ ঘটে। এককথায় বলতে গেলে আন্তসংস্কৃতি আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এই সামার স্কুল একটা সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে।
অসলো বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাড়াও অসলো বিশ্ববিদ্যালয় ও বারজেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর সামার প্রোগ্রামের আয়োজন করে। এসব কোর্সে বিশ্বের যেকোনো দেশের স্নাতক-উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারেন। আবেদনপত্র গৃহীত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদেশি, বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সব শিক্ষার্থীর জন্য পূর্ণ বৃত্তির ব্যবস্থা করে থাকে। এ ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবাসনের ব্যবস্থা করে।
তবে এটি যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক কোর্স এবং পড়ালেখার মাধ্যম যেহেতু ইংরেজি, তাই ইংরেজির প্রতি বিশেষ দখল থাকলে অগ্রাধিকার পাওয়া যায়। ভর্তির সব তথ্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া থাকে।
নরওয়ের পাঠদান পদ্ধতি আমাদের থেকে অনেকটাই আলাদা। গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও সক্রিয় আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে এখানে পাঠদান করানো হয়। সমসাময়িক বিষয়গুলোকেই এখানে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং সরেজমিনে বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা করে থাকে। এ ছাড়া প্রতিদিনের ক্লাস শেষে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে আগতদের ধারণা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দেখা ও জানার জন্য কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করে।
নরওয়েতে শব্দদূষণ নেই বললেই চলে। তার পরও বাইরে থেকে যেন কোনো শব্দ ভেতরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য ক্লাসরুমগুলো সাউন্ডপ্রুফ করা থাকে।
ক্লাসরুমগুলোতে মাল্টিমিডিয়াসহ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সব সুবিধা আছে। এখানে পড়তে আসা প্রত্যেকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ই-মেইল অ্যাকাউন্ট করে দেওয়া হয় এবং কোর্স-সম্পর্কিত সব তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের ফ্রন্টারে আপলোড করা থাকে। ওয়েবসাইটের ফ্রন্টার ব্যবহার করার জন্য প্রত্যেকের আলাদা করে অ্যাকাউন্ট থাকে এবং সেখানে শিক্ষার্থীরা নিজের আইডি দিয়ে লগইন করে সব তথ্য আপলোড ও ডাউনলোড করতে পারেন। নিজেদের মূল্যায়ন ঠিকভাবে স্বচ্ছ উপায়ে হচ্ছে কি না, সেটা দেখার জন্য ফ্রন্টারে প্রত্যেকের আলাদা পেজ থাকে এবং সেই পেজে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একাডেমিক সব তথ্য প্রতিনিয়ত আপডেট করা হয়। শিক্ষার্থীরা তাঁদের যেকোনো অভিযোগ বা মতামত এই ফ্রন্টারের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন।
সামার কোর্স বিশ্বের সব দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত এবং প্রতিটি দেশকেই সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়, অর্থাৎ এখানে দেশ বা মহাদেশভিত্তিক কোনো কোটা পদ্ধতি নেই। সবার জন্যই এখানে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা আছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থায় দেখা যায়, এশীয়দের সংখ্যা খুবই কম। আর বলতে গেলে এশীয়দের প্রতিনিধিত্ব করে ভারতের ছেলেমেয়েরা।
এশীয়দের কম উপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে এ কোর্সের সমন্বয়কারী হালভার্ড লাভল বলেন, ‘আমরা কোনো দেশকেই এখানে খাটো বা বড় করে দেখি না। সবার সমান অধিকার আমরা নিশ্চিত করে থাকি। সত্যি কথা হলো, এশিয়ার দেশগুলো থেকে আমরা পর্যাপ্ত আবেদন পাই না। আবার যা পাওয়া যায়, সবগুলো ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ করতে পারে না।’
ইউরোপ-আমেরিকার অনেকের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। অনেক সময় বলতে হতো, ভারতের পাশের দেশ আমরা। যাঁরা চিনত তাঁদের অনেকেরই ধারণা ছিল, বাংলাদেশ মানেই ক্ষুধা, দারিদ্র্য, খরা আর বন্যায় আক্রান্ত এক অনুন্নত দেশ। সামার স্কুলের সৃজনশীল ক্যাম্পে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তুলে ধরি। উদ্ভাবনী ক্যাম্পের মাধ্যমে নিজের এ দেশটিকে চেনাতে পেরেছি, এটাই এ সফরে আমার বড় প্রাপ্তি।
অসলো বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সামার স্কুল কোর্সের শেষের দিকে দুই দিনের উদ্ভাবনী ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। আগামী দিনে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য গতানুগতিক ধারার বাইরে কী কী নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে এবং সেই ধারণাগুলোকে কীভাবে সঠিক পন্থায় মানবসেবায় কাজে লাগানো যায়, এটাই উদ্ভাবনী ক্যাম্পের মূল উদ্দেশ্য।
tareq.mahamud@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.