সমকালীন প্রসঙ্গ-সরকারের ক্ষমাশীলতার কারণে দেশে অপরাধ বাড়ছে by বদরুদ্দীন উমর

বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড এখন এত নিয়মিতভাবে দেশের সর্বত্র ঘটছে যে, এটা এখানে প্রায় এক 'স্বাভাবিক' ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমে আসার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই বৃদ্ধির মূল কারণ, এই চরম অপরাধের জন্য দেশে কোনো শাস্তির ব্যবস্থা বাস্তবত নেই বললেই চলে।


ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে কোনো হত্যাকারীর শাস্তি হলেও শাস্তি না হওয়াটাই সাধারণ ব্যাপার। শুধু সাধারণ নাগরিক বা গরিব মানুষরা খুন হলেই যে তার কোনো বিচার ও শাস্তি হচ্ছে না তাই নয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ হত্যাকাণ্ডেরও কোনো যথাযথ বিচার এবং অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা এখানে নেই

বৈদ্যুতিক মাধ্যমের দুই সাংবাদিক স্বামী-স্ত্রী তাদের শোয়ার কামরায় আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হবে। এই মর্মে তিনি পুলিশকে নির্দেশ দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। যে কোনো হত্যাকাণ্ডের পর দু'দিনের মধ্যে হত্যাকারীকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করা যাবে এ কথা এভাবে ঘোষণা দেওয়া ছিল এক অবাস্তব ব্যাপার। এটা যে সম্পূর্ণ অবাস্তব তা ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার পরই দেখা গেল। শুধু ৪৮ ঘণ্টা নয়, আজ পর্যন্ত সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল-কিনারা যে পুলিশ পায়নি অথবা তারা এ ব্যাপারে কিছু বলতে অক্ষম, এটা এতদিন পর্যন্ত হত্যাকারী বা হত্যাকারীরা চিহ্নিত না হওয়া ও গ্রেফতার না হওয়ার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। এই অবস্থায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব এখন প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে নিয়েছেন! কোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ভার মন্ত্রণালয়, পুলিশ ইত্যাদি থাকতে প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে নেন, এ ধরনের কোনো দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে নেই। দুনিয়ার অন্য কোনো দেশেও নেই।
লক্ষণীয় ব্যাপার যে, এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সরকার পক্ষ থেকে এত কিছু বলা হলেও এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে তদন্তের কোনো প্রকৃত অগ্রগতি হয়েছে এটা পুলিশ অথবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথাবার্তা থেকে বোঝা যায় না। উপরন্তু এ ব্যাপারে সরকার নিজেই জল ঘোলা করছে। কয়েক দিন আগে এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সাংবাদিকদের সমাবেশে প্রদত্ত বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী, যিনি আবার এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ভার নিজের কাঁধে নিয়েছেন, এক সভায় বলেন, কারও বেডরুম পাহারা দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়! এ ধরনের কথাবার্তা, বিশেষত দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে শোনা অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। দেশের প্রত্যেকের বাড়ির বেডরুম যে সরকার পুলিশ বসিয়ে পাহারা দিতে পারে না, এমনকি এই চিন্তা পর্যন্ত যে উন্মাদতুল্য ব্যাপার এটা কে না জানে? তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কোন বিবেচনা থেকে এ ধরনের বক্তব্য এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রদান করলেন এটা বোঝার উপায় নেই। সাংবাদিকরা তাদের বক্তব্যের কোথাও কেউ তো কারও বেডরুম পাহারা দেওয়ার কথা বলেননি। তারা শুধু দাবি করছেন এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও দ্রুত তদন্ত, হত্যাকারী চিহ্নিতকরণ ও তাকে বা তাদের গ্রেফতারের। এই দাবি স্বাভাবিক। কাজেই এর জবাবে প্রধানমন্ত্রীর উপরোক্ত উত্তেজিত বক্তব্য যে সম্পূর্ণ অর্থহীন এতে সন্দেহ নেই। উপরন্তু এর থেকে বোঝা যায় যে, এই দাবি সাংবাদিকরা সমবেত ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের সামনে উপস্থিত করায় প্রধানমন্ত্রী খুবই অসন্তুষ্ট!
বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড এখন এত নিয়মিতভাবে দেশের সর্বত্র ঘটছে যে, এটা এখানে প্রায় এক 'স্বাভাবিক' ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমে আসার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই বৃদ্ধির মূল কারণ, এই চরম অপরাধের জন্য দেশে কোনো শাস্তির ব্যবস্থা বাস্তবত নেই বললেই চলে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে কোনো হত্যাকারীর শাস্তি হলেও শাস্তি না হওয়াটাই সাধারণ ব্যাপার। শুধু সাধারণ নাগরিক বা গরিব মানুষরা খুন হলেই যে তার কোনো বিচার ও শাস্তি হচ্ছে না তাই নয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ হত্যাকাণ্ডেরও কোনো যথাযথ বিচার এবং অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা এখানে নেই। মাত্র কিছুদিন আগে নরসিংদীতে মেয়রের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি খুন হলেন। সেখানকার লোকজন সকলেই হত্যাকারীদের সম্পর্কে জানেন, তাদের তারা নানা ঘটনা ও প্রমাণের মাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু মেয়র আওয়ামী লীগের লোক হওয়া সত্ত্বেও দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে তার হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা আজ পর্যন্ত হলো না। অবস্থা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে মনে করার কারণ নেই যে, হত্যাকারীরা চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের গ্রেফতার করা হবে, তাদের কোনো শাস্তি হবে।
এখানে প্রসঙ্গত অন্য একটি বিষয়ের উল্লেখ না করলে এ পরিস্থিতির বিপজ্জনক দিকটি স্পষ্ট হবে না। সে বিষয়টি হলো, হত্যাকারী পুলিশ তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত এবং আদালত কর্তৃক শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা অথবা সরকারের পেয়ারের লোক হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি তাদের ক্ষমা করছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে তিনি তাদের শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে দিচ্ছেন। লক্ষ্মীপুরে অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামকে খুন করার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের নেতা ও মেয়র আবু তাহেরের পুত্রকে রাষ্ট্রপতি 'দয়ার বশবর্তী' হয়ে ক্ষমা করেছিলেন। খুনির পিতা লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে আবেদন করার পর রাষ্ট্রপতি 'দয়াপরবশ' হয়ে তার আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। এই মেয়রের পুত্রকে ২০০১ সালে বিএনপি ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুই কর্মীকে হত্যার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্রে দেখা গেল যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে বলা হয়েছে যে, বিএনপির কর্মী কামাল এবং শিবিরের কর্মী মহসীনকে হত্যার জন্য তাদের যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতি দয়াপরবশ হয়ে তা কমিয়ে এনে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করেছেন! (ডেইলি স্টার, ২৭.২.২০১২)
এসব দৃষ্টান্ত থেকে মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির মন খুব নরম এবং তিনি এক দয়ার সাগর! কিন্তু একটি দেশের রাষ্ট্রপতি যদি চরম ক্রিমিনালদের প্রতি এই ধরনের দয়া প্রদর্শন শুধু একবার নয়, নিয়মিতভাবেই করে চলেন তাহলে সে দেশে যে অপরাধ বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই অন্যতম কারণ, যে জন্য বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে এক অপরাধের জগতে। অপরাধীরা জানে যে, যে কোনো ধরনের অপরাধ, এমনকি হত্যাকাণ্ড করলেও তাদের শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেই। বিচার ব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে তারা নিরাপদেই শাস্তি এড়িয়ে যেতে সক্ষম। দেশের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত ঘন ঘন হত্যাকারীদের প্রতি 'দয়াপরবশ' হয়ে তাদের ক্ষমা প্রদর্শন করে নতুন নতুন হত্যাকাণ্ড এবং অপরাধের সুযোগ সৃষ্টি করেন, সেখানে অপরাধীদের আইনকে পরোয়া করার কোনো কারণ নেই। তারা বেপরোয়া।
এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে দুই সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডের তদন্তভার নেওয়া এবং একই সঙ্গে বেডরুম পাহারা দেওয়া তাদের কাজ নয় বলে সাংবাদিকদের বিচার দাবির জবাবে বক্তব্য প্রদান থেকে এই সন্দেহ জনগণের মধ্যে দেখা দেওয়া সম্ভব যে, অন্য অনেক হত্যাকাণ্ডের মতো এই হত্যাকাণ্ডের কূল-কিনারাও পুলিশ শেষ পর্যন্ত পাবে না এবং এ ক্ষেত্রেও হত্যাকারীরা তাদের দ্বারা চিহ্নিত না হয়ে নিরাপদেই সমাজে বসবাস করবে এবং প্রয়োজনমতো আরও অপরাধ করা থেকে বিরত
থাকবে না।
২৭.২.২০১২

No comments

Powered by Blogger.