বাঘা তেঁতুল-প্রচারযজ্ঞ by সৈয়দ আবুল মকসুদ

বিধাতার এই বৈচিত্র্যময় বিশ্বে কত কী ঘটে! কত ক্ষেত্রে কত মানুষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তার ফলে অনেক মানুষই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পান। যেমন গত পরশু নেপালের চন্দ্র বাহাদুর দাঙ্গি বিশ্বের সবচেয়ে বেঁটে মানবের স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর বয়স ৭২, উচ্চতা ২১.৫ ইঞ্চি।


কোনো রাজধানী মহানগরের আধখানায় নির্বাচনের নাম-গন্ধ নেই। কবে নির্বাচন হবে তার ঠিকঠিকানা নেই। আদৌ দু-আড়াই বছরের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। শবে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের সংশোধনী শুরু হয়েছে। ৯০ দিনের পরিবর্তে ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করে সংসদে গত রোববার বিল উত্থাপিত হয়েছে। নিজস্ব লোকদের সুবিধার্থে আরও কতবার সংশোধনী আনার প্রয়োজন হয়, তা শাসক দল ছাড়া বিধাতার পক্ষেও বলা কঠিন। ওদিকে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলছে প্রবল বেগে। সেকেলে গ্রাম্য পদ্ধতিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট ভিক্ষা নয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রচারাভিযান। কোটি কোটি টাকা খরচ করে গিনেস বুকে ঠাঁই পেতে পারেন বাংলার মাটির এক, দুই বা তিন ভাগ্যবান প্রার্থীর যেকোনো একজন।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ কোনো কোনো বিষয়ে বিশ্বে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে। একবার নয়, পর পর বহুবার। দুর্নীতি বড়ই মধুর জিনিস। ধারণা করছি, বিশ্ব রেকর্ড অর্জনের মতো আরও অনেক কিছুই হবে এই বাংলার মাটিতে।
ঘর-সংসার, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, শালা-শালি, শ্বশুর-শাশুড়ি ছেড়ে দিয়ে নগরবাসীকে সেবা করার আকুলতা যে কোনো কোনো মানুষের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, তা ঢাকা মহানগর জবাই হওয়ার তিন মাস আগেও নগরবাসী জানত না। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে তরমুজের মতো ফালা দেওয়ার প্রস্তাব ধ্বনিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার সড়কগুলোর এ মাথা থেকে ও মাথায় টাঙানো হলো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ব্যানার। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিশাল হোডিং। প্রথম পর্বে এই মহৎ কর্মটির জন্য নেতাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। ডিজিটাল অভিনন্দন পর্ব।
তারপর সুপারসনিক গতিতে ঢাকা ভাগের বিলটি যখন পাস হয়ে গেল, তার তিন ঘণ্টার মধ্যে শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব। ‘ঢাকা দক্ষিণের সেবার সুযোগ দিতে নগরবাসীর কাছে আকুল আবেদন’-সংবলিত ব্যানার, পোস্টার, বিল বোর্ড, ফেস্টুন প্রভৃতি। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ছবিসহ ‘সৎ, যোগ্য মেয়র পদে নতুন প্রজন্মের সিদ্ধান্ত’ চেয়ে ব্যানার, বিলবোর্ড ও হোডিং। নিঃস্বার্থভাবে নগরবাসীকে সেবা করার আকাঙ্ক্ষা যে কী মারাত্মক হতে পারে, সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার আকুলতা যে কী দুর্দমনীয় হতে পারে, তা গোটা বাংলার মানুষ দেখতে না পেলেও, ঢাকা দক্ষিণের হতভাগ্য মানুষেরা দেখতে পাচ্ছে।
নির্বাচনী প্রচারাভিযান আমি দেখছি ১৯৫৪ সাল থেকে। ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারাভিযানেও অংশ নিয়েছি। দেখেছি ১৯৭০-এর নির্বাচন। কিন্তু ঢাকা-আধা ওরফে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থীদের প্রচারযজ্ঞ সেসবের কাছে নস্যি। বিংশ শতাব্দীর দশ দশক এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দর্শক—মোট ১১০ বছরে গোটা বিশ্বে যত নির্বাচন হয়েছে এবং তাতে যে মাত্রায় প্রচারাভিযান হয়েছে, তার সবগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে ঢাকা-আধা ওরফে ঢাকা দক্ষিণের প্রচারযজ্ঞ। প্রচারাভিযানে ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সবই হচ্ছে করপোরেশনের সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে। তাতে স্বার্থের লেশমাত্র নেই।
হতভাগ্য ঢাকা দক্ষিণের দেয়ালগুলোর যদি ভাষা থাকত, তারা আর্তনাদ করে বলত, আমার বুকে-পিঠে আর পোস্টার সেঁটো না। পোস্টারের ভারে আমি ভেঙে পড়ব। ইলেকট্রিকের খাম্বাগুলোর যদি কথা বলার ক্ষমতা থাকত, তারা জোড়হাত করে বলত, আমাকে উলঙ্গ থাকতে দাও। পোস্টারের পোশাকের আমার প্রয়োজন নেই। গাছ ও তার ডালপালা যদি রাষ্ট্রভাষায় কথা বলতে পারত, তারা বলত, আমাদের ওপর এই জুলুম কোরো না। আমাদের মতো আমাদের থাকতে দাও। খুবসুরত ছবিঅলা পোস্টার ব্যানার দিয়ে আমাদের ঢেকে দিয়ো না।
এই যে তিন-চার প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন, তা তাঁরা করছেন দলীয় পরিচয়ে। এ ক্ষেত্রে দলবিশেষের কি কিছুই করণীয় নেই? চার-পাঁচ রঙা বিলবোর্ড পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে পথ-ঘাট-অলিগলি। নির্বাচন কমিশনের কি কিছুই করণীয় নেই? অবশ্য তাঁরা যথার্থই বলবেন, আমরা তো নির্বাচনের সিডিউলই ঘোষণা করিনি। এখন কেউ ছয় ফুট লম্বা, ১০ রঙা পোস্টার ছাপলে আমরা কী করতে পারি?
যে কেউ যত খুশি টাকা খরচ করতে পারেন। সেটা তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকারও বটে। কিন্তু রাজস্ব বোর্ড তো জানতে চাইতে পারে, গত ১০ বছরে এই ধনকুবেররা কত টাকা আয়কর দিয়েছেন? তথ্য অধিকারের যুগে এটুকুও খবর নেওয়া যায়, ১৯৭২ বা ’৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁদের কী পরিমাণ ধনসম্পত্তি ও নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা ছিল।
ওসব ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার আগ্রহ নেই। আমার শুধু একটিই প্রশ্ন, আজ নেতার ছবির পাশে নিজের ছবি দিয়ে পোস্টার-বিলবোর্ড করেছেন। শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হওয়ার পর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির জন্য কয়খানা পোস্টার-ব্যানার ছেপেছিলেন?
দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে প্রশ্ন, দলের লোকেরা যা করেন তাতে কি আপনাদের সায় আছে? সায় থাক বা না থাক, দায় আপনারা এড়াতে পারেন না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.