কালান্তরের কড়চা-ওসামা বিন লাদেন নিহত, তিনি কি দীর্ঘজীবী হবেন? by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আজ বঙ্গদর্শন লেখাটি এক সপ্তাহের জন্য মুলতবি রেখে (পাঠকদের কাছে সবিনয়ে ক্ষমা চেয়ে) ভোরে ঘুম থেকে জেগেই যে খবরটি পেয়েছি, তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন মনে করছি। বহু খ্যাত এবং কুখ্যাত ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন সৈন্যরা পাকিস্তানে হত্যা করেছে। পশ্চিমা জগতের মিডিয়ায় খবরটি ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। মনে হয় যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে 'মিত্রপক্ষের' জয়ের খবর এবং আরেক হিটলারের মৃত্যুর খবর প্রচার করা হচ্ছে।


কিন্তু সত্যই লাদেনের মৃত্যু এবং যুদ্ধ জয় হলো কি? লাদেন তো 'অস্তিত্বহীন' বর্তমান আফগান-যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই। মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানে বর্বর বোমাবর্ষণ দ্বারা হাজার হাজার নিরীহ নরনারী হত্যা করেছে। কিন্তু লাদেনের অস্তিত্ব আর আবিষ্কার করতে পারেনি। তাঁকে ধরতে পারেনি। মারতেও পারেনি। মাঝেমধ্যে আলজাজিরা টেলিভিশন বা পশ্চিমা মিডিয়াই টেপে ধারণকৃত তাঁর ভৌতিক কণ্ঠস্বর প্রচার করেছে। কিন্তু লাদেন জীবিত কি মৃত_এই গুজবের অবসান আর হয়নি।
লাদেন জীবিত থাকুন আর না থাকুন, তিনি যে যুদ্ধ শুরু করে গেছেন, তা শেষ হয়নি। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ভয়াবহ মারণাস্ত্রসজ্জিত পশ্চিমা সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে আল-কায়েদা ও তালেবানদের যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। এই যুদ্ধ যাঁরা শুরু করেছিলেন, সেই বুশ ও ব্লেয়ার জুটি এখন আর ক্ষমতায় নেই, তাঁরা বিদায় নিয়েছেন। এখন ক্ষমতায় ওবামা-ক্যামেরন জুটি। আমেরিকা ও ব্রিটেনে তাঁরাও ক্ষমতা থেকে যথাসময়ে বিদায় নেবেন। কিন্তু লক্ষণ হলো, আফগান যুদ্ধের অবসান হচ্ছে না। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তা অনির্দিষ্টকাল চলবে।
ওসামা এখন আর এই যুদ্ধে কোনো ফ্যাক্টর ছিলেন না। তিনি মিথ হয়ে গিয়েছিলেন এবং আমেরিকার ক্লায়েন্ট স্টেট পাকিস্তানেই দীর্ঘকাল আত্মগোপন করে থাকতে পেরেছেন। এখন তাঁর অনুগামীরা যুদ্ধ চালাচ্ছে। এই যুদ্ধে 'অনুপস্থিত' ওসামা ও 'নিহত' ওসামার মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই। বরং জীবিত অথচ যুদ্ধে অনুপস্থিত (কার্যত পলাতক) ওসামা যেমন দিন দিন গুরুত্ব হারাচ্ছিলেন, এখন নিহত ওসামা সেই গুরুত্ব ১০ গুণ ফিরে পাবেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের একটা বড় অংশের কাছে শহীদ আখ্যা পাবেন। মার্কিন সেনারা চে গুয়েভারাকে হত্যার পর যেমন তাঁকে বিশ্ববরেণ্য করে তুলেছে, তেমনি তারা লাদেনকেও হত্যা করেছে_এই খবরটি সঠিক হলে তাদের হাতে লাদেন নবজীবন লাভ করলেন।
ওসামা বিন লাদেন এখন 'টেরোরিস্ট' থেকে 'মার্টিয়ার' হয়ে উঠবেন। চে গুয়েভারা জীবিত থাকতে যাঁরা তাঁর রাজনীতি পছন্দ করতেন না, তাঁরাও পরে যেমন চে-র ছবিওয়ালা গেঞ্জি পরে রাস্তায় ঘুরতে দ্বিধা করেন না; আমেরিকারও শহর-বন্দরে চে-র ছবি, আবক্ষ মূর্তি বিপুলভাবে বিক্রি হয়, তেমনি অদূর ভবিষ্যতে যদি বিশ্বের অধিকাংশ দেশগুলোতে তো বটেই, আমেরিকাতেও (যে দেশটিতে ওবামার নাম সবচেয়ে বেশি নিন্দিত ও ঘৃণ্য) মার্কিন তরুণ-তরুণীদের শরীরের উল্কিতে, বক্ষাবরণে এবং সামার ড্রেসে ওসামা বিন লাদেনের ছবি দেখা যায় এবং তাদের কাছে চে গুয়েভারার মতো কোনো এক আদর্শের সিম্বল হয়ে ওঠেন ওসামা, তাহলে বিস্ময়ের কিছু নেই। আমি অবশ্যই লাদেনকে চে গুয়েভারার সঙ্গে তুলনা করি না। কিন্তু মার্কিন সেনাদের হাতে মৃত্যু হওয়ার ফলে তাঁদের মরণোত্তর পরিণতি একই হবে বলে ধারণা করি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারকে হারানো সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু তাঁকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। তিনি তাঁর বাঙ্কারে বসেই আত্মহত্যা করেছিলেন। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে ওসামা বিন লাদেনকে (হয়তো) হত্যা করা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু তাঁকে পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর থেকে আমেরিকা তার সব মিত্র ও তাঁবেদার দেশ নিয়ে যে ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে চূড়ান্ত জয় দূরের কথা, আপাতত জয়েরও কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এই যুদ্ধব্যয়ের বিরাট ধাক্কা শুধু আমেরিকার নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে বিরাট ধস নামিয়েছে। যা ত্রিশের মন্দাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
কোনো কোনো মার্কিন সমরবিদই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, এই যুদ্ধে আমেরিকা বা ন্যাটোর সামরিক জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাঁদের এই কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায় তালেবানদের সঙ্গে আমেরিকার গোপন আপসরফার প্রচেষ্টার খবর দেখে। কোনো কোনো খ্যাতনামা মার্কিন অর্থনীতিবিদও এই বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে 'ওয়ার অন টেরোরিজমের' নামে পশ্চিমা যুদ্ধবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যের তেল লুণ্ঠনের জন্য যুদ্ধে নেমে যে লুটপাট চালাচ্ছে, সেই লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাবে। অর্থাৎ তেল লুটের টাকা অনির্দিষ্টকাল ধরে ব্যয়বহুল মারণাস্ত্র-ব্যবহৃত যুদ্ধে এমনভাবে ব্যয় হবে যে তাতে তাদের অপরাজেয় ধনবাদী ব্যবস্থায়ই পচন ও পতন দেখা দেবে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেই পশ্চিমা ধনবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের কবর তৈরি হতে পারে।
আমি ওসামা বিন লাদেনের সমর্থক নই এবং তাঁর মৃত্যুতে শোকাহতও নই। গত শতকের গোড়ায় বিশ্ব-ধনবাদ তার অভ্যন্তরীণ সংকট কাটাতে বর্বর ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছিল এবং পরে সেই ফ্যাসিবাদের দ্বারাই আক্রান্ত হয়েছিল। তেমনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে বিপর্যস্ত করার শেষে সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করা সত্ত্বেও গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম যে অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখোমুখি হয়, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য পলিটিক্যাল ইসলাম বা ইসলামিক টেরোরিজমের জন্ম দেয় এবং পরবর্তীকালে নিজেদের সৃষ্ট এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দ্বারাই আক্রান্ত হয়। প্রকৃত ইসলামের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
একজন ধনবাদী অর্থনীতিবিদই বলেছেন, 'ঈধঢ়রঃধষরংস ধষধিুং হববফং ধহ বহবসু ভড়ৎ রঃ'ং ড়হি ংঁৎারাধষ.' (ধনবাদের বেঁচে থাকার জন্য সব সময়ই তার একজন শত্রু দরকার)। তিনি আরো বলেছেন, এই শত্রু নিজেকেই সৃষ্টি করতে হয়। বিশ শতকের গোড়ায় ফ্যাসিবাদকে সে নিজেই তৈরি করে তার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। একই শতকের মধ্যভাগে কমিউনিজমকে তার শত্রু হিসেবে খাড়া করে তার সঙ্গে ঠাণ্ডা এবং গরম দুই ধরনের লড়াই চালিয়েছে। এরপর বিশ শতকের শেষদিকে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু না থাকা সত্ত্বেও ইসলামের নাম ভাঙিয়ে পলিটিক্যাল ইসলাম ও ইসলামিক টেরোরিজমকে জন্ম দিয়ে তাকে শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। ওসামা বিন লাদেন ছিলেন আমেরিকার বুশ পরিবারের বন্ধু এবং তাদের তেল ব্যবসায়ের পার্টনার। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকাই তাঁকে পলিটিক্যাল ইসলামের প্রতীক হিসেবে দীর্ঘকাল দুধ-কলা দিয়ে পুষেছে।
আসলে লাদেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিকা দীর্ঘকাল ধরে যা করছে, তা তাঁর ছায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কয়েক বছর ধরেই আফগান ও পাকিস্তানের যুদ্ধে লাদেন একটি ছায়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি কায়া হয়ে ওঠেননি। তিনি জীবিত না মৃত, তা নিয়েও বিতর্ক ছিল। আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য পাঁতি-পাঁতি করে খুঁজেও তাঁকে পায়নি। পাকিস্তান তো সরাসরি অস্বীকার করে এসেছে, লাদেন তাদের দেশে নেই। তবু যুদ্ধ চলছিল এবং যুদ্ধ চালাচ্ছেন লাদেনের অনুগামীরাই, লাদেন নন। একমাত্র টেপকৃত ভৌতিক কণ্ঠস্বর (যা তাঁর বলে দাবি করা হয়েছে) ছাড়া তাঁর অস্তিত্বের আর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এখন মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা পাকিস্তানে তিনি নিহত হয়েছেন, খবরটি সঠিক হলে প্রমাণ পাওয়া গেল, ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানেই ছিলেন এবং এখন আর তিনি ছায়া নন, কায়া হয়ে উঠলেন। জীবিত লাদেনের চেয়ে মৃত লাদেন অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবেন এবং তাঁর মৃতদেহ কবরে শুয়ে এখন পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দেবে। লাদেনের নাম হয়ে উঠতে পারে এই যুদ্ধের মূলমন্ত্র।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারকে পরাজিত করার পর তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল যখন লন্ডনের ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের দরজায় দাঁড়িয়ে দুই আঙুল তুলে বিজয়ের ভি (ঠ) চিহ্ন দেখাচ্ছিলেন, তখন এক ইতিহাসবিদ মন্তব্য করেছিলেন, 'চার্চিল যুদ্ধ জয় করেছেন, কিন্তু সাম্রাজ্য হারিয়েছেন। হিটলার পরাজিত হয়েছেন, কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন।' কথাটা সম্ভবত আজকের আমেরিকা ও লাদেন সম্পর্কেও সত্য। চার্চিলের মতো বুশ অবশ্য তাঁর যুদ্ধে জয়ী হননি, কিন্তু লাদেনকে অদৃশ্য (পলাতক) হয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। এখন লাদেন নিহত হয়েছেন বটে, কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অগি্নতপ্ত বালুতে এই সাম্রাজ্যবাদকে এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে রেখে গেছেন, যে যুদ্ধে মূষিকের হাতেই হয়তো সিংহের মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে।
মৃত্যুর পর অধিকাংশ মুসলিম দেশের মতো বাংলাদেশেও যদি (ভারত এবং পাকিস্তানেও) শান্তিকামী গণতন্ত্রমনা মানুষ পছন্দ না করা সত্ত্বেও ওসামা বিন লাদেন নামটি কোনো একটি অনুকরণীয় কাজের পপুলার প্রতীক হয়ে ওঠে, তাহলে বিস্ময়ের কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী ও উগ্র মৌলবাদীরা তাদের বর্তমান পড়ন্ত অবস্থা ঠেকা দেওয়ার জন্য ওসামা নামটিকে রক্ষাকবচ করে তুলতে পারে এবং বুকে ও বাহুতে ধারণও করতে পারে। এখানেই বাংলাদেশ সরকারকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে এবং বাস্তব নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
একটি পুরনো কথা, কোনো ইজম বা আইডিয়া, ভালো-মন্দ যা-ই হোক, তাকে অস্ত্র দ্বারা ধ্বংস করা যায় না। লাদেনবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও পশ্চিমা শক্তি তাই বিভীষিকা সৃষ্টিকারী মারণাস্ত্র দ্বারাও জয়ী হচ্ছে না। লাদেন বহু বছর ধরে এমনিতেই ছায়া হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে হত্যা করে কায়া করে তোলা হয়েছে। তাঁকে অমরত্ব দান করা হলো বলেও অনুমান করা চলে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা সেক্যুলারিস্ট সরকারও যদি মধ্যযুগীয় কোনো আইডিয়া বা ইজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে চায়, তাহলে কেবল শক্তিপ্রয়োগ বা দমননীতি প্রয়োগ দ্বারা তাতে সফল হতে পারবে না। তাকে পাল্টা আইডিয়া ও মতবাদের যুদ্ধে নামতে হবে এবং এই যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। লাদেনের মৃত্যু বাংলাদেশেও গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের জন্য যে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে, তা মোকাবিলার জন্য সেক্যুলারিস্ট রাজনৈতিক দলগুলো এবং বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার আদৌ সতর্ক আছে কি?
লন্ডন ২ মে, সোমবার, ২০১১
(ধারাবাহিক লেখাটির শেষাংশ আগামী সপ্তাহে)

No comments

Powered by Blogger.