কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-করতে করতে করণটারে শেষ করে দে এক্কেবারে by রণজিৎ বিশ্বাস

'মরতে মরতে মরণটারে/শেষ করে দে এক্কেবারে' এই কথাটি কী এখন আর আমাদের বলবার বা মানবার দরকার আছে! মরতে আর হবে কেন দেশের মানুষকে। মরা কী তারা কম মরেছে! : আপনার কথা আমি মানি। সময়ে সময়ান্তরে মরা তারা কম মরেনি।


তারা বিজয়ের জন্য মরেছে, তারা আবার সংসপ্তকের মতোও মরেছে। তারা মরণে ভয় করে না, বরং 'ভয় কী মরণে' চিৎকার করে। তাদের করতে হবে এবং করতে করতে 'করার কাজগুলো' শেষ করতে হবে। যেমন, তেমন একটি কাজ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সুবিচার করা। এখনকার কথা হচ্ছে করতে করতে করণটারে শেষ করে দে এক্কেবারে।
: যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সুবিচার করা বলতে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন?
: কেন! আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি, তা আপনি বুঝতে পারছেন না! লা'নত নামুক আপনার 'পরে। আপনি তো দেখছি বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে কদম বাড়াচ্ছেন!
যুদ্ধাপরাধী ও একাত্তরের ঘাতকদের প্রতি সুবিচার করার অর্থ হচ্ছে_তাদের যথাপ্রাপ্য যথাসময়ে বুঝিয়ে দেওয়া। সে প্রাপ্য যে দণ্ডই হোক।
: বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা কিংবা ছদ্মমুক্তিযোদ্ধাদের এখন কি আর চেনার উপায় আছে? তাদের কেউ কেউ তো অকালে অসময়ে অপঘাতে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার কারণে বেঁচে গেছে।
: তারপরও চেনার উপায় আছে। যারা বলে, সেইফ কাস্টডিতেও মানুষের ওপর অত্যাচার হয়, যারা সাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক, যারা মানুষকে মানবসন্তান হিসেবে গ্রহণ করার আগে তার জন্মপরিচয় ও উপাস্যবিচার করে, তারা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেদের সংযোগসম্পর্ক দাবি করলেও, সে সংযোগ-সম্পৃক্তি ঘটনাক্রমে পেয়ে যাওয়া। তারা বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা, তাদের এজেন্ট দালাল অথবা ধামাধরা।
: তাহলে সেইফ কাস্টডি বা সেইফ হোম ইত্যাদি বলতে আমরা কী বুঝব?
: ভেরী সিম্পল বুঝব! যে কাস্টডি সেইফ ও যে হোম নিরাপদ তাই বুঝে নেব!
: কিন্তু তা তো বুঝে নেওয়া যাচ্ছে না!
: যাচ্ছে না কেন?!
: আপনি দেখেন নি কিছু লোক অন্যরকম প্রচারে নামার আগে লবণমাখা আদার সঙ্গে কয়েক ঘটি জল গিলে নিয়েছে!
: অন্যরকম প্রচারটা কী রকম প্রচার?
: তারা বলছে_সেইফ হোম হলো যুদ্ধাপরাধী, মানবতার দুশমন ও একাত্তরের ঘাতক দালালদের টর্চার সেলের অন্য নাম।
: তাহলে তাদের প্রশ্ন করতে পারেন_পীড়ন প্রকোষ্ঠের অন্য নাম কি তাহলে নিরাপদ নিবাস?
: তালেগোলে, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাওয়া বা বাই-চান্স মুক্তিযোদ্ধাদের আরো কি কোনো বৈশিষ্ট্য আছে?
: আছে মানে! এক শ বার আছে!
তারা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দেবে। আমাদের দেশে মানুষকে আবেগতাড়িত করার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ধর্মকে কাজে লাগাবার জন্য নষ্ট বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটাবে। মানুষের মনের সাত পাতালের নিচে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িকতাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলবে, চাগিয়ে দেবে।
: সেটি কিভাবে পারা যায়?
: পবিত্র গ্রন্থের দোহাই দেওয়া যায়, সেটি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়া যায়, তার অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যায় মানুষের অন্তর তাতানো যায়।
: দেশের মানুষ কি তা বোঝে না?
: অধিকাংশ লোকই বোঝে না। আমি তো আপনার অনুমতি নিয়ে বলতে চাইব, অনেক চোখাচোখা লোকও না বুঝে বোকা বনে বসে থাকে। সংশয়বিদ্ধ হয়ে আমরা ভাবি_কথাটা কি তাহলে সত্যি! যদি ফিফটি পারসেন্টও সত্যি হয়, আমরা চিন্তায় পড়ে যাই, তাহলেও তো ভয়ের কথা! আর যারা বিনাশর্তে ধর্মতাড়িত হয়, তাদের ফিফটি পারসেন্ট, নিদেন টুয়েন্টি থার্টি পারসেন্টকে 'এক নয়ানের বাইসন' বানিয়ে নিতে পারলেই তো মতলববাজ ওই মন্দলোকেদের কম্মো কাবার!
: এমন সাফল্যে তারা কেন বিকোয় বলতে পারেন?!
: পারি। যে পবিত্র গ্রন্থগুলোর নামে আমরা লবেজান হয়ে উঠি, তা কি আমরা ভালো করে কখনো পড়েছি? না, কখনো পড়ব?! অন্যের কথা বাদ দিন, আমি আর আপনি, যে দুজন এখন সংলাপ বিনিময় করছি, আমরা তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সোপান পর্যন্ত শেষ করেছি। আপনি আপনার জন্মপরিচয় অথবা নির্বাচিত কিংবা স্বেচ্ছাগৃহীত ধর্মপরিচয়ের মহাগ্রন্থ ভালোভাবে বুঝে সমঝে আনুপুঙ্খ আন্তরিকতায় কয়বার পড়েছেন আমি জানি না, আপনি জানেন কি না আপনিই জানেন; আমি কিন্তু আমার জন্মপরিচয়সূত্রে প্রাপ্ত গ্রন্থটি অর্ধবার কিংবা সিকিবারের জন্যও শেষ করিনি! একেবারে প্লেইন ট্রুথ ও ক্লিন কনফেশান! এবং, আপনি চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখুন শিক্ষিত সমাজে কিন্তু আমরাই মেজরিটি! আপনার-আমার মতো লোকই বেশি। ধর্মপরিচয় ও জন্ম পরিচয়ের দিক থেকে যদি বলেন, আমার বাবা ওই পরিচয়ের ছিলেন বলেই আমি তাঁর পরিচয়ের; আপনার বাবা অন্য পরিচয়ের ছিলেন কিংবা আছেন বলেই আপনিও একই পরিচয়ের।
আপনি ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করে দেখবেন, এই মানুষগুলোই আমরা ভয়াবহভাবে কঠোরকট্টর কিংবা মৌলবাদী নই অথবা অন্ধসাম্প্রদায়িকতা বা ছদ্মসাম্প্রদায়িকতাও আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু, নষ্টলোকের বিরুদ্ধে, মন্দলোকের বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রদায়িক ছদ্মসাম্প্রদায়িক ও ভেদবুদ্ধিচালিত মতলববাজদের বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়াই না। দাঁড়াতে পারি না। সবার কাজ হয়ে যায় 'কারও কাজ নয়'।
পারি না বলেই কিছু লোক কেলানো দাঁতে বলে বলে পার পেয়ে যায়_আমার দেশে আইনের সবচেয়ে বড় বইতে ধর্মের কথা ঠাঁই পাবে কি না, কোন বিশ্বাসের বাণী উচ্চারণ আমি তার পাঠ শুরু করব কি না, তা ঠিক করে দিচ্ছে এক বিধর্মী ও ভিনধর্মী।
: দেশের মানুষ তো তা গেলে না!
: আপনার মতো আমিও যদি নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত হতে পারতাম, ভালোই লাগত।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.