কক্সবাজার ট্র্যাজেডি-তুমি রবে নীরবে by কামাল লোহানী

পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন জেগে উঠে।' গাইবে অনেকেই। কিন্তু আবিদ আর গাইবে না। অথচ এই গানেই মাত করে দিয়েছিল আবিদ একটি প্রতিযোগিতায়। শীর্ষদের একজন হয়ে সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। এই প্রতিযোগিতায় পড়বার সময় সে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।


কিন্তু আবিদ তো এইখানেই নয়, ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক ঐতিহ্যে ঋদ্ধ হয়ে আবিদ, না বাপী খুলনার সংস্কৃতি অঙ্গনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিল মা রমা আর বাবা মিনা মিজানের হাত ধরে। বাবা মিনা মিজান ছাত্রজীবন থেকেই গান রচনা, সুর দেওয়া এবং গাওয়া সবই করতেন। এ ছাড়া ছিলেন একজন সুদক্ষ সংগঠক। আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক পরিচয়টাই ছিল বড়। মা কলেজ শিক্ষিকা হওয়া সত্ত্বেও সংস্কৃতি আন্দোলনে জড়িত। তার পারিবারিক প্রভাবও এখানে এসে মিশেছিল। এমনই মা আর বাবার শিক্ষা এবং আদর্শে দীক্ষিত হয়ে বাপী (আবিদ) নিজেকেও গড়ে তুলেছিল একই পথে। কিন্তু প্রতিতা বিকাশের যখন পরম লগ্ন উপস্থিত সে সময় বাপী সবার মায়ার বাঁধন ছেড়ে চলে গেল। যখন সে পথ খুঁজে পেয়েছিল নিজেকে বিকশিত করার, ঠিক সেই মুহূর্তেই চলে গেল অকালে। এ তো কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। মা তার আহাজারিতে উন্মাদ, বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। নাড়ি ছিঁড়ে যে সন্তানকে জন্ম দিয়েছিলেন, চঞ্চলতা চরিত্রকে সঙ্গীতের মোহনরূপে সাধ্য করে তুলেছিলেন মা আর বাবাই কিন্তু চলে যাওয়ার মুহূর্তে কক্সবাজারের কলাতলী সমুদ্রসৈকতে অপরাহ্ন বেলায় তিরিক্ষে মেজাজের আগ্রাসী সমুদ্রের কোলে স্নান করতে গিয়ে ভাটার টানে পড়ে মৃত্যুকে দিয়েই জীবনের সমাপ্তি টেনে গেল বাপী আমাদের সবার অজান্তে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পেঁৗছে গেল খবর টেলিভিশনের স্ক্রলের মাধ্যমে। সবাই উদগ্রীব হলেন, কেন এবং কেমন করে এসব হলো। বাপীরা চারজন স্নানে নেমেছিল কিন্তু তিনজনই শেষ। দুটি লাশ পাওয়া গেলেও একজনের লাশ তখনও পাওয়া যায়নি। ওরা কক্সবাজার গিয়েছিলেন একটি কর্মশালার কাজে। বিকেল ৫টায় নেমেছিল সমুদ্রে। সন্ধ্যায় নাকি মৃত্যুখবর ঘোষণা করা হয়েছে। ওরা যখন ভাটার সময় সমুদ্রে যাচ্ছে তখন কেউ কি ঠেকাতে পারেননি? ওদের বয়সের চেয়ে বড় দায়িত্বশীল কেউ কি ছিলেন না ওদের সঙ্গে এমন অবধারিত মৃত্যুর হাতছানি থেকে ওদের থামাতে? ভাটার সময় সমুদ্র খুবই বিপজ্জনক। চোরাগোপ্তা গহ্বর আছে সমুদ্রের বুকে, তাতে আটকে গেলে নাকি আর ফিরে পাওয়ার জো থাকে না। যা হোক, ওদের দু'জনার লাশ পাওয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকর্মীরা তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান, সেখানে তাদের মৃত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। মায়ের বুকটা হয়তো অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল। সবার অজান্তে নিভে গেল সেই অমর কণ্ঠ আবিদ শাহরিয়ার। তারই সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করা তরুণ তূর্য ছিল। ওর বাড়ি রাজশাহীতে। মা-বাবার একমাত্র ছেলে সে। আবিদের সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুবাদেই নয়, তূর্য নিজেও গীটারবাদক বলে আবিদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে ওঠে। থাকতও একসঙ্গে। তূর্য রাজশাহীর ছেলে।
আবিদ শাহরিয়ার বিবিএ পাস করে এমবিএতেও ভর্তি হয়েছিল আর সে সঙ্গে খ্যাতিমান অভিনেতা ও বিজ্ঞাপন চিত্রনির্মাতা আফজাল হোসেনের প্রতিষ্ঠান মাত্রায় যোগ দিয়েছিল নতুন কাজ করার জন্য। আবিদের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আসছে ডিসেম্বরেই হওয়ার কথা ছিল। মা তার বিয়ের জন্য গয়না গড়িয়ে রেখেছিলেন। এখন আপনজনদের শুধাচ্ছেন, 'কী করব এ গয়না দিয়ে?' শহীদ মিনারেই শুনলাম মেয়েটি এখন নিউইয়র্কে। আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। কিন্তু ও যদি আসতেও পারে আবিদকে আর তো পাবে না। ফ্লাইট না পেয়ে মেয়েটির আপনজন চিত্রকর দম্পতি কাজী নকীব ফুল হাতে এসেছিলেন শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ওই দয়িতার পক্ষে।
কী মর্মান্তিক! ভাবা যায় কি? বাবার কাঁধে ছেলের লাশ। একি প্রাণস্পর্শী দৃশ্য। তবু মিনা মিজান দৃঢ়চিত্তে পরিবারের সবাইকে নিয়ে চবি্বশ ঘণ্টা নির্মম প্রতীক্ষায় থেকেছেন। করার কিছু ছিল না। লাশ কক্সবাজার থেকে ঢাকা হয়ে খুলনা গেছে। হায়রে পোড়া কপাল, ঢাকা-খুলনা রাস্তার যে কী দুর্বিষহ অবস্থা! অবশেষে মরদেহ বহনকারী গাড়িটি পেঁৗছেছিল রাত ৮টায়, অপেক্ষমাণ অগণিত মানুষ। তাদের প্রিয় খুলনার কৃতী সন্তান যে আবিদ তাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে, যে আবিদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে এই বাংলার নাম গর্বে উচ্চারণ করতে সুযোগ করে দিয়েছিল, সে আবিদ আজ আসছে চিরবিদায়ের পোশাক পরে। ছলছল চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। মানুষের ঢল নেমেছিল হাদিস পার্কে। আবিদের বড় প্রিয় প্রাঙ্গণ। এখানেই তো ওর শিল্পী জীবন বিকাশের শুরু। তিলতিল করে যে শিক্ষা বাবা তাকে দিয়েছিল সৌম্যমূর্তি হিসেবে গড়ে উঠতে, তারই অনন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এখানেই, হাদিস পার্কের একুশে কিংবা বিজয় দিবসের কোনো অনুষ্ঠানে। সে আজ থেকে কম করে হলেও ১০-১২ বছর আগের কথা। সম্ভবত সে তখন স্কুল পর্যায়ে এইট কি নাইনে পড়ছিল। তখনই তো অগি্নস্ফুলিঙ্গের মতো ছিটকে বেরিয়েছিল এক সুগঠিত শিল্পীসত্তা। ওই ছোট বাপীর অনুষ্ঠান উপস্থাপনা দেখে এবং শুনে তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। ঘোষণা করছে, আবিদ আবৃত্তিও করছে সেই সঙ্গে। কী অসাধারণ গুণাবলি ওর ওই ছোট্ট কিশোর সত্তায়। গান গাইছে আবার অভিনয়েও ছিল পোক্ত। নিষ্ঠুর সমুদ্রের আগ্রাসী জলরাশি এক আচানক হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা করে তরুণ সমাজকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ওদের তিনজন-তিন বন্ধু আবিদ, তূর্য আর আশিক_ ওরা চলে গেল মুহূর্তেই, মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন আর অগণিত বন্ধুবান্ধবকে অকুল সাগরে ভাসিয়ে। তিন বন্ধুর এ সলিলসমাধি আমাদের নন্দনজগতের সংস্কৃতির নবপল্লবে পুষ্পিত তিনটি তরুণপ্রাণকে কেড়ে নিয়ে গেল। এ শোক বুকভাঙা। এ শোক সইবার নয়। তবু সইতে হবে।
আবিদকে আমি দেখেছি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট খুলনার একুশে উদযাপন অনুষ্ঠানে। চঞ্চল, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, বিনয়ী এবং শুদ্ধাচারের প্রতীক যেন ছিল সে। তখন বয়স যতই থাকুক না কেন, পারিবারিক পরিবেশের কারণে প্রগতিশীল দুনিয়ার খবর তাকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল। ওদের ঘরটাই ছিল গণশিল্পী সংস্থার খুলনা অঞ্চলের সূতিকাগার। তাই সেই হামাগুড়ির কাল থেকে আবিদ আমাদের প্রিয় বাপী গণশিল্পীরই একজন হয়ে গিয়েছিল। তাই পারিবারিকভাবেই হোক আর সাংগঠনিকভাবে বাপী ছিল আমাদেরই সন্তান।

কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.