চরাচর-নীরবতাই গণতন্ত্রের মৃত্যু by সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

বিশ্ব মুক্ত সংবাদমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে এ বছর বেছে নেওয়া হয়েছে 'ঝরষবহপব শরষষং ফবসড়পৎধপু, নঁঃ ধ ভৎবব ঢ়ৎবংং ঃধষশং' স্লোগানটি। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশের সঙ্গে এবারই প্রথম তৈরি হয়েছে এই স্লোগানের আরবি সংস্করণ। সংবাদমাধ্যম যে কতটা শক্তিশালী, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, যেখানে শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিদ্রোহীদের জড়ো হওয়ার ডাক দিয়েছে এসব মাধ্যম।


১৯৯১ সাল থেকে ৩ মে পালন করে আসা এই দিনটিকে সামনে রেখে বিশেষ কিছু আয়োজনের মধ্যে দুটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পেপার অ্যান্ড নিউজ পাবলিশার্স গণতন্ত্রের অবরুদ্ধতা প্রকাশে কিছু স্থিরচিত্র তৈরি করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি হলো_মুখে স্কচটেপ দিয়ে আঁটা মহাত্মা গান্ধী এবং অং সান সু চির প্রতিকৃতি। আরেকটি হলো, বিশেষ দিনটিতে সংবাদপত্রের একটি অংশ ফাঁকা রাখা। সব সংবাদপত্রকে অনুরোধ করা হয়েছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি এবং যা এখনো বলা হয়নি, তার প্রতীক হিসেবে একটি অংশ এদিন ফাঁকা রাখার জন্য। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া_সব ধরনের সংবাদমাধ্যমই রাষ্ট্রের পরিচয়ে পরিচিত হলেও এর নিয়ম-নীতিনির্ধারণীর ক্ষেত্রে রয়েছে কিছু আন্তর্জাতিক নিয়ম। তেমনি নিয়মের অনুশাসনের পাশাপাশি আবার সংবাদমাধ্যমগুলোর রয়েছে তথ্যপ্রাপ্তি এবং তা প্রকাশের অধিকার। বিশ্ব মুক্ত সংবাদমাধ্যম দিবসের মূল কথাও তা-ই। আর মত প্রকাশের এই অধিকারই গণতন্ত্র। শাসক এবং দেশের রাজনীতির আওতামুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশের ক্ষমতা থাকবে সংবাদমাধ্যমের। দিনটির তাৎপর্য এখানেই। কিন্তু এখনো সংবাদমাধ্যম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরাধীন হয়ে কাজ করে। এর উদাহরণ ২০১০ সালে স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে ৫৯ জন সাংবাদিকের মৃত্যু। গত বছর বিশ্ব মুক্ত সংবাদমাধ্যম দিবসের ভাষণে গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা প্রদান সরকারের দায়িত্ব বলে মন্তব্য করেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগের কোনো দৃষ্টান্ত এখনো তৈরি হয়নি। বাংলাদেশেও পাস হয়েছে নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার বিল। কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি কিংবা সময়োপযোগী নয়, এই দোহাই দিয়ে হরণ করা হচ্ছে এই স্বাধীনতা।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। সর্বজনীন মানবাধিকারের ১৯ নম্বর ধারায় এই অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু শাসক তার শাসন দিয়ে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখছে অধিকার। তবে এখানে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো করে তথ্য প্রকাশ কিংবা ভারতের রতন টাটার টু জি মোবাইল ফোনের লাইসেন্স নিয়ে গোপন তথ্য প্রচার যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তা আলোচনাসাপেক্ষ। একদিকে কখনো কখনো তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম হরণ করছে মানবাধিকার, রাষ্ট্রের অধিকার। আরেকদিকে শাসক তার দুর্নীতি লুকাতে প্রতি মুহূর্তে কড়া নজরদারিতে রেখেছে এই মাধ্যমকে। ফলে সাধারণ মানুষ যে তথ্য তার প্রতিদিনকার জীবনে প্রভাব ফেলছে, তা থেকে বেশির ভাগ সময়েই বঞ্চিত হচ্ছে। কখনো আবার একটি সংবাদকে প্রবাহিত করা হচ্ছে ভিন্ন খাতে। এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তাই তথ্য থেকে বঞ্চিত এবং সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ আরোপ মানবাধিকার হরণেরই নামান্তর, যার উদাহরণ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

No comments

Powered by Blogger.