জনরুচি-‘কোলাভেরি ডি’ কিংবা ‘বুকটা ফাইট্টা যায়’: শুধুই কি হুজুগ? by সুমন রহমান

সম্প্রতি তামিল গায়ক ও নায়ক ধানুশের গাওয়া ‘কোলাভেরি ডি’ গানটা নিয়ে ভারতীয় সংগীতজগৎ বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই গান ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে। বাংলাদেশেরও অলিগলিতে, গাড়ি-বাড়িতে বেজে চলেছে সমানে।


২০১২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৩০ মিলিয়ন বারেরও বেশি ইউটিউবে শেয়ার হয়েছে এই গানটা; ফেসবুক, টুইটারেও প্রায় একই রকম। রিলিজ হওয়ার ১৮ দিনের মধ্যেই দুই লাখেরও বেশিবার মোবাইলে ডাউনলোড করা হয়েছে গানটি। ভারতীয় অন্যান্য ভাষায় এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ইভেন্টে এই গান ব্যবহার করা হয়েছে। কিছুদিন আগে এক ট্যাক্সিচালক দুর্নীতির অভিযোগে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী শারদ পাওয়ারকে যে চড় মেরেছিলেন, তার টিভি ফুটেজও ব্যবহূত হয়েছে ‘কোলাভেরি ডি’ গানের ভিডিও হিসেবে। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডায় কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়েই এই গান ব্যবহার করে চলেছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে দেওয়া রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় এই গানের গায়ক ধানুশকেও দাওয়াত দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সিএনএনের বিবেচনায় ‘কোলাভেরি ডি’ ২০১১-এর দুনিয়াসেরা গান। পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি অনলাইন শেয়ারের জন্য ইউটিউবের তরফ থেকেও জুটেছে সোনার পদক।
কী কারণে এই গানের এত বিপুল জনপ্রিয়তা? কী আছে এই গানে? প্রশ্ন তাড়া করে ফিরেছে অনেক সংগীতবোদ্ধাকে। শুধু সংগীত নয়, এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে নানা জায়গা থেকে। পত্রিকার কলামিস্ট, বিনোদন-সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক ভাষ্যকারেরা বিস্তর লিখেছেন, এমনকি ব্যবসা-প্রশাসন ইনস্টিটিউটগুলো পর্যন্ত এই গান নিয়ে রীতিমতো বাজার-গবেষণা করে ফেলেছে এরই মধ্যে। সবাই যে বিষয়ে একমত তা হলো, এই গানটি জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ এর ভাষাভঙ্গি। ‘টাংলিশ’ নামে তামিল ও ইংলিশের একটি সংকরভাষায় গাওয়া হয়েছে এই গান। পাশাপাশি, এই গানে রয়েছে দক্ষিণী সংগীতের সুর ও বাদনভঙ্গি। এ সবই এ গানের বিপুল জনপ্রিয়তার উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।
কিন্তু সংকরভাষা কী উপায়ে একটা গান তথা কোনো শিল্পকর্মকে জনপ্রিয় করে? ‘কোলাভেরি ডি’ গানের ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে এখানে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি ব্যবহার করা হয়েছে গানের লিরিকে। ইংরেজি শব্দগুলো যে তরিকায় অর্থপূর্ণ হয়ে উঠছে, অর্থাৎ ব্যাকরণ বা বাক্যগঠনরীতি, সেটি কিন্তু ইংরেজির নয় বরং তামিল ভাষার। অর্থাৎ ‘টাংলিশ’ নামের যে সংকরপনা দিয়ে এই গান রচিত, সেটিকে ইংরেজি ভাষার শব্দ আর তামিল ভাষার বাগবিধি একত্র করে বানানো হয়েছে।
মিথোজীবিতার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবিলা করার এ এক নয়া তরিকা। এই তরিকায় শব্দরাজি, যা কিনা মানবিক অভিজ্ঞতার নির্যাস হিসেবে ভাষায় উঠে আসে, তাকে উদারভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু যে বিধিব্যবস্থা (বাগবিধি ও ব্যাকরণ) এসব শব্দকে একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক সীমায় ঐতিহাসিকভাবে বিন্যস্ত করছে, তাকে বর্জন করা হচ্ছে। একটা শব্দ, সেটা যে ভাষারই প্রাথমিক সম্পদ হোক, তার সঙ্গে ভিনভাষায় যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু যখনই সেই শব্দ বা শব্দসমষ্টি কোনো একটি ভাষার বিধিব্যবস্থার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়, তখন তা ওই ভাষাসংস্কৃতির ক্ষমতাকাঠামোকেও প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে তার সঙ্গে তখন যোগাযোগটাও প্রাতিষ্ঠানিক হতে বাধ্য। এও মনে রাখতে হবে, শব্দ পয়দা হয় ময়দানের খোলা হাওয়ায়, আর ব্যাকরণিক বিধিব্যবস্থা বানানো হয় শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত বৈঠকখানায়। আর এই দুই জিনিস দুটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মানুষজনের হাতেই তৈরি হয়।
‘কোলাভেরি ডি’ জনপ্রিয় হয়েছে, কারণ এই গান তামিল বয়ানে ইংরেজি শব্দ চালিয়ে দিয়ে একটা নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের নিশানা দেখিয়েছে। উগ্র স্বদেশিপনা নয়, আবার লিবারেল বিশ্বনাগরপনাও নয়, বরং এমন একটি জায়গা এই গানে শনাক্ত হয়েছে, যার মাধ্যমে এই উভয় ঐতিহাসিক রীতির প্রতি সমালোচনা হাজির করা যায়। দৃষ্টান্ত দিয়ে বললে, ইংরেজিকে প্রত্যাখ্যান নয়, বরং এমন তরিকায় গ্রহণ করা হয়েছে, যার ফলে এই পরিসরে উৎপাদিত ইংরেজি খোদ ইংরেজের অপরিচিত হয়ে উঠেছে। অথচ তামিল-ভিন্ন অপরাপর ভারতীয় ভাষাগোষ্ঠীগুলোর জন্যও এই সংকরপনা বিন্দুমাত্র অপরিচয়ের আবহ তৈরি করে না। অদ্ভুত বিষয়: গান গাওয়া হচ্ছে ‘অনলি ইংলিশ’-এ, সেটা ইংরেজ বুঝতে না পারলেও আশপাশের কুলিকামিন, অল্পশিক্ষিত নেটিভ, শিক্ষিত তারুণ্য—সবাই বুঝছে! প্রভুর ভাষায় প্রভুকে বোকা বানানোর মজাই আলাদা!
এভাবে ‘কোলাভেরি ডি’ তার উদ্দিষ্ট শ্রোতাগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন করে। এ কারণেই এই গান এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ঠিক একই কারণে বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মমতাজের গাওয়া ও শাহ আলম সরকারের লেখা সুর করা ‘বুকটা ফাইট্টা যায়’ গানটিও। ওই গানেও ‘কোলাভেরি ডি’-এর মতো প্রমিত ও সভ্য ভাষার বিধিব্যবস্থার সঙ্গে নিম্নবর্গের একটা বোঝাপড়া হাজির ছিল। আর সেই বোঝাপড়াটি করা হলো প্রধানত শহরবাসী বিশাল নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর তরফে, যাদের গানের শ্রোতা এবং ক্রেতা হিসেবে এর আগে কখনোই সিরিয়াসলি ভাবা হয়নি। শহরবাসী শিক্ষিত ও প্রমিত উচ্চবর্গের মর্মে মর্মে বিঁধেছিল এই অপমান। ফলে, কোনো ধরনের যৌন ইঙ্গিত সরাসরি বহন না করেও ওই গান ‘অশ্লীল’ গানের অপবাদ বহন করে গেল দীর্ঘদিন। ইত্যবসরে, এমন অনেক গানই রচিত হয়েছে যা যৌনতার সূত্র সরাসরি বহন করেও অশ্লীল বিবেচিত হয়নি। এসব গান সেন্সরবোর্ড পার হয়ে সিনেমায় গীত হয়েছে, বাজারে অ্যালবাম আকারে বিক্রিও হয়েছে। তবু কেউ বলেনি এগুলো অশ্লীল, কারণ হয়তো এটাও যে এগুলো ভাষার বিধিব্যবস্থাকে কাঁচকলা দেখায়নি। শাহ আলম সরকারের ওই গানে বুকটা যদি ‘ফাইট্টা’ না গিয়ে ‘ফেটে’ যেত, তবে নিশ্চয়ই এই গান শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কানে এত অশ্লীল লাগত না!
‘বুকটা ফাইট্টা যায়’ মানভাষার আধিপত্যকে প্রশ্নাতীত না-ভাবার মধ্য দিয়ে তার শ্রোতাগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন করেছে। কিন্তু সে গ্রামীণ বা লোকভাষায় প্রত্যাবর্তন করেনি। করলে সেটা নিশ্চয়ই অরাজনৈতিক ও অনৈতিহাসিক হতো। যে ভাষাটি আমাদের নিগৃহীত নিম্নবর্গ তার শহরবাসের দিনগুলোতে পলে পলে শিখছে, যে ভাষাটি প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের একটি গনগনে শহরে অভিবাসনের বেদনা, রাষ্ট্রের উপেক্ষা, মিডিয়ার মশকরা, অভিজাতের অবজ্ঞা, আগুন আর বুলডোজারের আশঙ্কায় কাঁপতে থাকা বস্তিগুলোর নানা গলিঘুপচির ভেতর, সেই ভাষারই গান এটা। ‘বুকটা ফাইট্টা যায়’ আমাদের চিরচেনা গার্মেন্টস-বালিকার, কারণ তারই অপুষ্ট দেহের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে কামানো বৈদেশিক মুদ্রায় তার মনিব পাজেরো চালান, আর এই অনাত্মীয় শহর প্রতিদিন তার জীবনীশক্তি শুষে নেয় একটু একটু করে। উৎপাদনের মূল হাতিয়ার যে শ্রমিক, তাকে রীতিমতো ইতর গণ্য করে পুঁজির বেপরোয়া স্তূপীকরণের এই নমুনাটুকু প্রতীকায়িত হয়ে উঠেছে এই গানে, প্রতারক প্রেমিকের রূপকে, ভাষার এহেন ব্যবহারের মাধ্যমে। পেলব প্রমিত ভাষার আয়নায় এই নির্মম শ্রমশোষণের ছবি কীভাবে ধরা পড়ত?
‘মার্জিত’ ভাষা ক্ষমতাসীনের সংস্কৃতি, তার পক্ষে জনভাষাকে সন্দেহ করা স্বাভাবিক। যে শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে আমরা বেড়ে উঠি, তারই ঐকান্তিক ও ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা আমাদের ওই রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকাঠামোর ‘মার্জিত’ নাগরিক বানিয়ে তুলতে চায়। যার ফলে, এমনকি নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রও শিক্ষার সম্প্রসারণের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী থাকে, কারণ শিক্ষার বিস্তার সব সময় স্ট্যাটাস ক্যু বহাল রাখে। আবার, যা কিছু জনপ্রিয়—তাকে ‘বানিয়ে তোলা’ বা নিছক ‘হুজুগ’ বলে নাক সিঁটকানো শিক্ষিতের চিরকালীন আভিজাত্য। সে কারণেই হয়তো আমরা কোনো দিন ভেবে দেখিনি একটা গান কেন এতখানি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যে গানের আবার ‘মহৎ’ ও ‘মার্জিত’ কোনো ভাবভাষা নেই। ততটুকু ক্লেশ স্বীকার করলে হয়তো আমরা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভিড়ের অনামা মুখগুলোর আনন্দ ও বেদনার জায়গাগুলোকে আরও নিবিড়ভাবে জানতে ও চিনতে পারতাম!
সুমন রহমান: কবি, কথাসাহিত্যিক।
sumanrahman@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.