সময়ের প্রেক্ষিত-পরে যেন পস্তাতে না হয় by মনজুরুল হক

বেশ কিছুদিন আগে এই একই বিষয়ে একটি লেখা আমি লিখেছিলাম। তবে এর কোনো প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। কেননা, যাদের উদ্দেশ করে সেই লেখা, তাদের মধ্যে কোনো রকম আলোড়ন যে সেটা একেবারেই তুলতে পারেনি গত তিন বছরের ঘটনাবলির আলোকে প্রসঙ্গটির একেবারে হারিয়ে যাওয়া থেকে তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।


আমার সেই লেখার বিষয়বস্তু ছিল নির্বাচনী প্রক্রিয়া, এবারও যে একই বিষয়ের ওপর আরও একটু বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করতে আমি প্রয়াসী।
বাংলাদেশের গত চারটি সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে ত্রুটিপূর্ণ যে একটি বিষয় সহজেই আমাদের সামনে ধরা দেয় তা হলো, ভোটের ফলাফল জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সব সময় সুবিচার করছে না। বিগত চার নির্বাচনে প্রধান দুই দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হার ছিল ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের নাগরিকদের প্রত্যাশার আলোকে বলা যায় যে তুলনামূলকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ এমন একটি সংসদ তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন, একক একটি দলের একচেটিয়া প্রাধান্য থেকে মুক্ত থেকে জনপ্রতিনিধিত্বের সঠিক প্রতিফলন যে সংসদ তুলে ধরবে। তবে আমাদের সমকালীন বাস্তবতা বলছে, নাগরিকদের সেই প্রত্যাশা পূরণে আমরা ব্যর্থ হয়েছি ত্রুটিপূর্ণ একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা চালু থাকার কারণে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, দুই দশক ধরে ত্রুটিপূর্ণ সেই দিকটি বলা যায় আমাদের দৃষ্টির বাইরেই থেকে গেছে এবং বিষয়টি নিয়ে সেভাবে কোথাও আলোচনা হতে শোনা যায়নি।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যেহেতু হচ্ছে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটানোর সবচেয়ে কার্যকর প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা, ফলে জনতার প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সংসদীয় পদ্ধতি গড়ে নেওয়া না গেলে গণতন্ত্রও অনেকটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই অগ্রসর গণতান্ত্রিক দেশগুলো আজকাল একক আসনের নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে সরে এসে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যাশার আরও অনেক সঠিক মূল্যায়ন করে নিচ্ছে। ফলে নাগরিকদের প্রায় ৩৫ শতাংশের সমর্থন পেয়েও সংসদে মাত্র ১৫ শতাংশ আসন নিয়ে আঙুল চুষে রাগ ও দুঃখ চেপে রাখার মতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখে রাজনৈতিক দলগুলোকে সেখানে পড়তে হচ্ছে না, যা কি না ঘটতে দেখা গেছে আমাদের গত সব কটি নির্বাচনের শেষে। ভবিষ্যতেও যে এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটবে তা মনে হয় না, যদি না এখনকার ক্ষমতাসীন দলটি সেই বাস্তবতা অনুধাবন করে নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হয়।
সেই উদ্যোগ কীভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে সে পথ দেখিয়ে দেওয়ার বিশেষজ্ঞের অভাব দেশে থাকার কথা নয়। তার পরও বিদেশের একাধিক দৃষ্টান্ত অনুকরণযোগ্য হয়ে দেখা দিতে পারে। তবে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার আগে মনে হয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা দরকার।
আমাদের ৩০০ আসনবিশিষ্ট সংসদ গঠিত হয়েছে ১৯৭২ সালে সংবিধান কর্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে, যা কি না বাস্তব আকার নিয়ে কাজ করতে শুরু করে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা তখন ছিল সাড়ে সাত কোটি। বর্তমানে সেই জনসংখ্যা ১৬ কোটিতে উন্নীত হলেও আমাদের সংসদ সদস্যের সংখ্যায় তেমন কোনো রদবদল হয়নি। ফলে বলা যায় যে, আগে যেখানে একজন সাংসদ গড়ে আড়াই লাখ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতেন, সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এখন দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখের বেশিতে। সে রকম অবস্থায় নিজেদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের শরণাপন্ন হওয়া মানুষের জন্য এখন হয়ে উঠেছে অনেক বেশি কষ্টকর। এদিক থেকেও তাই গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে অনেকটাই যেন কোণঠাসা এবং সাংসদেরা হয়ে উঠছেন দূরের মানুষ। এই ত্রুটিও আমাদের অবশ্যই সংশোধন করে নেওয়া দরকার। কীভাবে এই দুই সংশোধনী একক এক পথে আনা যেতে পারে, সেই দৃষ্টান্তও অন্যান্য কিছু দেশের দেখিয়ে দেওয়া পথে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। জাপানের দৃষ্টান্ত এদিক থেকে অনুকরণযোগ্য গণ্য হতে পারে।
১৯৯৪ সালে নির্বাচনী আইন সংস্কার বিল অনুমোদনের মধ্য দিয়ে জাপানের সংসদ নতুন যে নির্বাচনী ব্যবস্থা দেশে চালু করে, তা এখনো জাপানে কার্যকর। নিম্নকক্ষের আসনসংখ্যা ৫১১টি থেকে পাঁচ শতে কমিয়ে আনা ছাড়াও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও সরাসরি নির্বাচন ভিন্ন এই দুই প্রক্রিয়ার সমন্বয় ঘটিয়ে নিয়ে যে নির্বাচন-প্রক্রিয়া জাপানে তখন চালু করা হয়, তা এ কারণে খুবই ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে যে এর ফলে একক একটি দলের একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখার পথ এখন বলা যায় অনেকটাই বন্ধ। নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত উদার গণতন্ত্রী দল সংসদের উভয় কক্ষে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হলেও নতুন এ ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার পর থেকে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। নিম্নকক্ষের আসনসংখ্যা শুরুতে নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫০০টি, পরবর্তী সময়ে যা ২০টি কমিয়ে ৪৮০টি নির্ধারণ করা হয়। মোট সেই আসনসংখ্যার ৩০০টি নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে সরাসরি নির্বাচনের জন্য, অর্থাৎ আমাদের দেশের নির্বাচনের মতোই সর্বোচ্চ ভোট লাভকারী যেখানে বিজয়ী হয়ে থাকেন। অন্যদিকে ১৮০টি আসন বিভিন্ন দলের মধ্যে তাদের পাওয়া মোট ভোটের আনুপাতিক হিসাবে বণ্টন করা হয়। তবে এই ক্ষেত্রে দলগুলোকে অবশ্য আগে থেকে প্রার্থীদের তালিকা নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করতে হয়, যে তালিকার ক্রমানুসারে কোন দল থেকে কারা বিজয়ী হচ্ছেন তা ঠিক করে নেওয়া হয়। অর্থাৎ উদার গণতন্ত্রী দল যদি দলের লাভ করা ৫০টি আসনের বিপরীতে ৭০ জনের তালিকা দাখিল করে থাকে, সে রকম অবস্থায় তালিকার প্রথম ৫০ জন বিজয়ী নির্ধারিত হবেন। তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের আসন বণ্টনে অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দূর করে নিতে দেশকে মোট ১১টি অঞ্চলে ভাগ করে নিয়ে আসন বণ্টন করা হয়।
বাংলাদেশে এখন ক্ষমতাসীন দলটি যেহেতু সবিধান সংশোধনীর জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ আসনের অধিকারী, ফলে এ রকম সুবিধাজনক অবস্থান কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র ১৫ শতাংশ আসন পাওয়ার মতো অনাহূত অবস্থা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া দলটির পক্ষে সম্ভব। কীভাবে তা সম্ভব, তারও একটি হিসাব জাপানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই করে নেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা গত ৪০ বছরে দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় সংসদের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সবচেয়ে জুতসই পথ তাই হতে পারে আসনসংখ্যা ৩০০টি থেকে বাড়িয়ে ৫০০টি নির্ধারণ করে নিয়ে বাড়তি ২০০ আসন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট রাখা। ফলে, অন্তত ২০০ আসনে জনতার পছন্দ-অপছন্দের প্রতিফলন সঠিকভাবে ফুটে উঠলে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েও একেবারে সর্বস্ব হারানোর মতো বিপদ এড়িয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে সম্ভব হবে। আর তাই ভবিষ্যতে আবারও যেন আঙুল চুষে ভাগ্য কিংবা অপরকে দোষারোপ করতে না হয়, সে জন্য এখনই উদ্যোগ নেওয়া অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?
টোকিও, ২৯ জানুয়ারি, ২০১২
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.