বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ ও সমাজ-ভাবনা by শহিদুল ইসলাম

এক. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু কলকাতায় ছাত্রাবস্থায়। সেখানে তিনি পাকিস্তানি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। দেশভাগের পর ঢাকায় এসে মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হন। মুসলিম লীগবিরোধী গ্রুপ বা ব্যক্তিদের সঙ্গেই তাঁর ওঠাবসা।


১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে জনগণের (আওয়ামী) মুসলিম লীগ গঠিত হয়। 'আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মধ্য দিয়েই শেখ মুজিবের ছাত্ররাজনীতি থেকে বৃহত্তর রাজনীতিতে উত্তরণ ঘটে, জাতির অবিসংবাদিত নেতৃত্বের শিখরে আরোহণে এ-ই ছিল প্রথম সোপান।' দেশভাগের পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ রাজনীতির বিরোধিতাকারীদের মধ্যে প্রথমেই যাঁদের নাম করতে হয় তাঁরা হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এঁদের বলা যায় শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু। দ্বিতীয় সারির নেতৃত্বের মধ্যে আমরা পাই শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহমদ, আবুল মনসুর আহমদ, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আতাউর রহমান খান, অলি আহাদ ও ইয়ার মহম্মদকে। এঁদের শেষে দুজনের নাম যোগ করা যায়। তাঁরা হলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমান। পঞ্চাশের দশকে আন্দোলন-সংগ্রামে শেখ মুজিব প্রথম সারিতে থাকলেও প্রথম তিনজনের প্রভাববলয়ের কারণে শেখ মুজিব ছিলেন অনেকটাই ম্লান। ফজলুল হক নিজেকে নানা বিতর্কে জড়িয়ে তাঁর পূর্বের সুনাম ধরে রাখতে পারেননি। ভাসানী পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক জটিলতার কারণে আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি নেন। সোহরাওয়ার্দীর জীবিত অবস্থায় আওয়ামী লীগের ওপর শেখ মুজিবের নিয়ন্ত্রণ ততটা স্পষ্টতর হয়নি।
দুই. সাধারণত ধারণা করা হয় যে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। কিন্তু তা সঠিক নয়। বাষট্টির আগেও ছাত্রদের আরো দুটি আন্দোলনে নামতে হয়েছিল। প্রথমত, সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, দ্বিতীয়ত, আইয়ুবি সংবিধানবিরোধী আন্দোলনে মার্চ মাসে। তারপর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে। প্রথম দুটি আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলো যেটুকু অংশগ্রহণ করে জেল-জুলুমের সম্মুখীন হয়েছিল, শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের আহ্বান সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রকাশ্য তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সেপ্টেম্বরে তিনি মুক্তি পান। তিনি ঢাকায়, পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, দুই লাখ মানুষের এক জনসভায় সংবর্ধনা পান। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে এক বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। শেখ মুজিব চাইছিলেন আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবন দান করে তাঁর নেতৃত্বে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলবেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সংবিধান গণতন্ত্রীকরণের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী দল বা গ্রুপ নিয়ে একটি মোর্চা গড়ে তুলবেন। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (NDF) গড়ে তোলেন। এ মোর্চায় ছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ((NDF), কৃষক-শ্রমিক পার্টি, কাউন্সিল মুসলিম লীগ (নজিমুদ্দিন) ও মুসলিম লীগ (নুরুল আমিন)।
তিন. সোহরাওয়ার্দী পরে বৈরুতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। নবাবজাদা খাজা নাসরুল্লাহ খান সভাপতি ও শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালের মার্চে ঢাকায় এনডিএফের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় সব দলের নেতারা যোগ দেন। সভা শেষে নুরুল আমিনকে সভাপতি করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৪ সালে জাতীয় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়। সে উপলক্ষে আইয়ুববিরোধী আরেকটি মঞ্চ গঠিত হয়-'কপ' (COP-Combined Opposition Party)। এই জোটে থাকে আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। জোট আইয়ুবের বিরুদ্ধে মিস ফাতিমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেয়। জামায়াতে ইসলামীর সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী ছাড়াও দশজন নামকরা আলেম রাষ্ট্রপ্রধান পদে মহিলা নির্বাচন জায়েজ বলে এক ফতোয়া প্রদান করেন।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে প্রমাণিত হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান কতটাই অরক্ষিত। ফলে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অপরিহার্য বলে দাবি করেন এবং ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ছয় দফা ঘোষণা করেন। তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতা করার জন্য আইয়ুব খান লাহোরে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সব বিরোধী দলের নেতাকে ডেকেছিলেন। ওই কনভেনশনে শেখ মুজিবকে না যাওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ উঠেছিল এ দেশে। ন্যাপ ও এনডিএফ ওই সম্মেলনে যায়নি। ওই কনভেনশনে মোট ৭৪০ জন প্রতিনিধির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছিলেন মাত্র ২১ জন। তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের পাঁচজন। ছয় দফা উত্থাপন করলে কণ্ঠভোটে তা বাতিল হয়ে যায়। শেখ মুজিব সম্মেলনস্থল ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন।
চার. শেখ মুজিব ছয় দফার বিষয়গুলো দেশবাসীর সামনে ব্যাখ্যা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের কোনায় কোনায় সভা-সমাবেশ করতে থাকেন। তিনি প্রতিদিন সকালে গ্রেপ্তার হন, বিকেলে ছাড়া পেয়ে আরেক জনসভায় বক্তৃতা করেন। ১৯৬৬ সালের ৮ মে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত ২০ মার্চ থেকে ৮ মে ৫০ দিনে ৩২টি সভায় বক্তৃতা করেন। ভাসানীর ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের ছয় দফা সমর্থন করেন না। বরং ভাসানীর সঙ্গে আইয়ুব খানের সম্পর্ক ক্রমেই উন্নত হতে থাকে। পিন্ডিতে আইয়ুব খানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়। অতঃপর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর কালাবাগের আমিরের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। আওয়ামী লীগকে খণ্ড খণ্ড করার জন্য আইয়ুব খান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নাসরুল্লাহ খানের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত হন বলে জানান কমরুদ্দিন আহমদ। ভীতসন্ত্রস্ত আইয়ুব খান আওয়ামী লীগের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাকে গ্রেপ্তার করেন। এ অবস্থায় ১৯৬৭ সালের ২ মে ঢাকায় আইয়ুববিরোধী (?) রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা আতাউর রহমান খানের বাসায় বসে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট_পিডিএম (PDM) গঠন করেন। এতে ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, এনডিএফ ও জামায়াতে ইসলামী। পিডিএমে যোগদানের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ আবারও দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এক, ছয় দফাপন্থী; দুই, পিডিএমপন্থী। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কিছু রক্ষণশীল নেতা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে পিডিএমে যোগ দেন।
পাঁচ. এটা ইতিহাসের কথা। এখানে ব্যক্তিগত বিশ্লেষণের কোনো স্থান নেই। কে কিভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবে জানি না। কিন্তু আমার প্রশ্ন, শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সর্বেসর্বা না হয়ে উঠতে পারলে তাঁকে যদি এনডিএফ, 'ডাক' ও পিডিএমের মধ্যে কাজ করতে হতো, তাহলে কি আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোট পেত? দেখা যায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ মুজিব পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন দলের সঙ্গে আঁতাত করেছেন, কিন্তু ঠিক সময়মতো সবার পরামর্শ না শুনে তিনি আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করে বাঙালির স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছেন। এখানেই শেখ মুজিবের বিরাট কৃতিত্ব।
যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা, আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্রদের এগারো দফার মূল বিষয়ের মধ্যে এক ঐক্যবদ্ধতা দেখা যায়। তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন। লাহোর থেকে ফিরে ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব ছয় দফা ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন যে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষা করতে হলে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে এর উভয় অংশকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে সব বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। একটি রাষ্ট্রের কেন্দ্রকে শক্তিশালী করলেই সে রাষ্ট্রটি শক্তিশালী হবে_এমনটি ঠিক নয়। বরং একটি যুক্ত রাষ্ট্রের ফেডারেটিং ইউনিটগুলো শক্তিশালী করতে পারলেই ওই রাষ্ট্রটি শক্তিশালী হবে এবং ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। একুশ, ছয় ও এগারো দফা ক্রমেই যেমন এক দফায় এসে মিলিত হয়েছে, তেমনি হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর ভিন্ন মতাদর্শিক পথগুলো ক্রমেই এক হয়ে মিশে গেছে শেখ মুজিবের মধ্যে। তাহলে স্বায়ত্তশাসন নয়। স্বাধীনতা_বাঙালির স্বাধীনতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাঙালি জাতির স্বাধীনতা। ১৯৪৮ সালের মার্চে পাকিস্তানি জাতির পিতা জিন্নাহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে চাননি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্য নাকি একটি 'কমন' ভাষা দরকার। সামান্যতম রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকলে বুঝবেন ৫৬ শতাংশ মানুষকে অস্বীকার করে, তাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে পদদলিত করে পাকিস্তান টিকতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন :
'বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন
বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক
হে ভগবান।'
কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, 'এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির_আমাদের।
বাঙলা_বাঙালির হোক। বাংলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।'
বাঙালির এ দুই শ্রেষ্ঠ কবির স্বপ্ন পূরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজবিদ

No comments

Powered by Blogger.