সংস্কৃতির জন্য নিরর্থক হাহাকার by লুৎফর রহমান রনো

মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় কোনো কিছুই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, আপাত বাধাবিপত্তি ছাড়া। অথচ এই মানবসভ্যতার বিকাশের ইতিহাসজুড়ে আধিপত্যবাদের প্রভাব একচ্ছত্র। বড় ছোটকে গিলে খাবে, একেবারে গিলে না ফেললেও প্রভাবিত করবে, স্পষ্টকে প্রচ্ছন্ন করে তুলবে। এ নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম নেই।


সংস্কৃতির বেলায়ও এ সত্যের বরখেলাপ হওয়ার নয়। আর এ জন্য সত্তা কিংবা সংস্কৃতি রক্ষার জন্য দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে যদি অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে হয়, তাহলে আলো-বাতাসের অভাবে তার মৃত্যু অবধারিত হয়ে দাঁড়ায়। তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বাক্সের বিনোদন-আগ্রাসন যদিও আমাদের ভাষা বা সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তবু কি তা বন্ধ করা যাবে? বন্ধ করে দেওয়া কি যৌক্তিক? আসল কথা হলো, আমরা আমাদের ভাষা, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসি না বলেই আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক শক্তি সঞ্চয় করতে ব্যর্থ হচ্ছি, আর এ ব্যর্থতার ফাঁকে ঢুকে পড়ছে বিশ্বায়নের পণ্য-সংস্কৃতির বিষাক্ত নখর। গত ৪০ বছরে আমাদের জাতীয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যেসব উপাদান যুক্ত হয়েছে, সেসবের কশাঘাত হজম করেও যে আমরা আজও স্বপ্ন দেখতে সক্ষম, তা-ই বা কম কিসের! একেবারে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিপ্রীতি, দলপ্রীতি, শিক্ষালয়ে সন্ত্রাস-খুন, পড়াশোনা না করে শিক্ষার সনদপ্রাপ্তি, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে চাকরিপ্রাপ্তি, খুন করেও জামিন বা খালাস পাওয়া। বাণিজ্য ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য না করে অঢেল মুনাফার ধান্দা। সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি মানুষের পকেটে ছুরি চালিয়ে ব্যবসায়ীরা লুটে নিচ্ছেন টাকা। ব্যবসায়ীরা ডাকাত হয়ে উঠেছেন, ছাত্ররা ব্যবসায়ী হচ্ছেন, ডাকাতরা নির্বাচনে জয়লাভ করে গলায় মালা ঝোলাচ্ছেন। শিক্ষকরাও ভোটাভুটি করেন, দল পাকান, আবার নিরীহ শিক্ষকরা নেতাদের হাতে বেঘোরে মার খান। এসব অনাচার-অত্যাচার, অনৈতিকতাই এ দেশের সংস্কৃতির তথা সমাজের কোষে কোষে সংক্রমিত। সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের নামচিহ্ন প্রায় নিশ্চিহ্ন। বুদ্ধিজীবীরা পরোক্ষভাবে ভাড়ায় খাটেন এখন। এনজিওতে, রাজনীতিতে বুদ্ধি বিক্রি করেন। দামি দামি পণ্যে ভোগবিলাসের মাদকতায় বিশ্ব অস্থির এখন। এই মাদকতার সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে ব্যর্থ বুদ্ধিজীবীরা পণ্যের পেছনে ছুটছেন। এমপি-মন্ত্রীদের যেমন গাড়ি-বাড়ির ভোগবিলাসের সুবিধা করে দিচ্ছে সরকার, তেমনি সত্য গোপন ও মিথ্যাকে সত্য করে তোলার জন্য কিছুসংখ্যক লিখিয়ে মাথা বন্ধক দিয়েছেন। এ দেশে কারো অবসর ও ইচ্ছা কোনোটাই নেই মাতৃভাষার মর্যাদা নিয়ে ভাবার, ভাষার বিকাশের জন্য কাজ করার, সাহিত্য-শিল্প নিয়ে কথা বলার। কী যে সাহিত্য আর কী যে অসাহিত্য, শিল্প কী বা কোন রচনা শিল্পসম্মত, কোনটি নয়- কেউ নেই তা দেখার, বলার। তিরস্কার কার জোটে, কে পায় পুরস্কার- তার কোনো নীতি-রীতি নেই। সব কিছুই এখন বিবেচ্য পণ্যের বিচারে। চানাচুর-চকোলেটের যেমন, তেমন বইপত্রের মোড়কের চাকচিক্য, বিজ্ঞাপনের আধিক্য থাকলেই চলবে- ক্রেতা পাবে, পাঠক গিলবে, বাণিজ্য চলবে। শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনেও সেই দুর্নীতি, রাজনীতি, মুনাফানীতি-চালাকি, চৌর্যবৃত্তি প্রভৃতি। আমরা তো দেখছি, আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, ভাষা, দেশপ্রেম- সবই ব্যাধিগ্রস্ত, ক্ষয়গ্রস্ত। আমাদের কোন সংস্কৃতির জন্য তাহলে হাহাকার? কোন জায়গাটায় বাঙালি সংস্কৃতি আজ দাঁড়িয়ে নিচ্ছে তার
ক্লান্ত নিঃশ্বাস?
ভারতের চলচ্চিত্র এ দেশে চলবে কি চলবে না এ ঝগড়াটাও ব্যবসায়ীদের- সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে হলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মান এতটা মানহীন হয়ে পড়ত না। একে তো হিন্দি ভাষা ভাষার বিচারে খুবই সাবলীল ও শ্রুতিমধুর। তদুপরি তাদের চলচ্চিত্রের কাহিনী ও সংলাপের মান ঈর্ষণীয়। তাদের গীতিকার, কাহিনীকার ও সংলাপ রচয়িতার প্রতিভা, নিষ্ঠা প্রভৃতির খবরাখবর আমরা প্রায় সবাই পড়ে থাকি। তাই এই 'উদার' পৃথিবীতে উৎকৃষ্ট পণ্য নিকৃষ্ট পণ্যকে হারাবেই। কলকাতার গল্প-উপন্যাসও আমাদের আক্রমণ করে থাকে। এই আক্রমণ-সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য যত চিন্তা ও দুশ্চিন্তা। কিভাবে মানোন্নয়ন করা যায় সে চিন্তা যদি হতো, ভালো হতো। বর্তমান পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি এখন অন্য রকম। পণ্য-ধন্য বিশ্বের আলো-বাতাস পর্যন্ত মুক্ত নয়, বাণিজ্যিক জালে আটকে পড়েছে সবই। তাই মানুষের মন-মেধা, আবেগ-অনুভূতি- সবই এখন টাকার বিনিময়ে প্রকাশ পায়। প্রতিভা হলেই আজকাল আর চলে না। তাই নিজেদের সাহিত্য, শিল্প, চলচ্চিত্র অর্থাৎ সংস্কৃতির এই ওপর-কাঠামোর শ্রীবৃদ্ধি ও শিকড়-সমৃদ্ধির জন্য পুঁজি বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। এখন নাটকের জন্য বিজ্ঞাপন নয়, বিজ্ঞাপনের জন্য নাটক রচনা করা হয়। বিজ্ঞাপন আপনাকে দেখতেই হবে, মাঝেমধ্যে নাটকের ঝলক। গাড়িতে-বাড়িতে, পথে-ফুটপাতে, বোর্ড-বিলবোর্ডে, ব্যানারে-টিভি চ্যানেলে চ্যানেলে চিৎকার আর চাঞ্চল্যকর, রোমাঞ্চকর ঠাট্টা-মশকারা তারকাদের। সবই বিজ্ঞাপন। পণ্যের সেবা দিচ্ছে সবাই। মিথ্যার সায় দিচ্ছে নায়ক-মহানায়ক কিংবা স্বপ্নের রানিরা। চীনে নাটকের সময় বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আমরা তা পারব? তাই অপসংস্কৃতি বলতে কিছু নেই- বলা ভালো, জগৎজুড়ে এখন পণ্য-সংস্কৃতি। আমাদের সর্বপ্রকার পণ্যের গুণগত মান বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। সে জন্য পুঁজি ছাড়া অন্য কোনো পাথেয় নেই। বাঙালি সংস্কৃতির যা কিছু শিকড়লগ্ন, সত্যলগ্ন- তা আজও অবিকল বেঁচে আছে 'বাঙালিদের' মধ্যে। সেই ভাষা, দেশপ্রেম, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অসুখ-বিসুখ-মৃত্যু- অথচ জীবনের গান থেমে নেই মাঠে-হাটে-ঘাটে, নদী-খালে-বিলে। যাঁদের আশঙ্কা সংস্কৃতি বিনাশের, তাঁরা, আমরা- সবারই শেখার ও উপলব্ধির অবাধ প্রান্তর হলো সেসব মানুষের হৃদয়, আর বঞ্চিত-লাঞ্ছিত নারী ও শিশুর নির্বাক ভাষা। তাই ভোগবিলাস ও লুটেরাদের রাষ্ট্রীয়, জাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে আগে বাঁচাতে হবে তাঁদের, যাঁরা শিকড়ে জলসিঞ্চন করেন। ওসব মাটিলগ্ন মানুষকে বাঁচালে বাঁচবে সংস্কৃতিও।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.