লব্ধাকর ঘটনা by এ এম এম শওকত আলী

২ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে শুনানির সময় আলোচ্য ঘটনাটি ঘটার পর বিষয়টি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই মিডিয়ায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়াসহ সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, বার কাউন্সিল তথা সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এটা হচ্ছে একটি কলঙ্কিত ঘটনা। ঘটনা সূত্রে প্রকাশ, শুনানির সময় একটি প্লাস্টিকের বস্তু বিচারপতিদের লক্ষ্য করে ছোড়া হয়।


লজ্জাজনক ঘটনার আরেকটি দিক ছিল উপস্থিত আইনজীবীদের একাংশের ব্যক্তিদের 'ধর' 'ধর' শব্দ উচ্চারণ, যা সাধারণত রাস্তাঘাটে অপরাধীদের ধরে গণপিটুনির জন্য উচ্চারিত হয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে ঘটনার মূল কারণ ছিল সংবিধান সম্পর্কিত একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতার কটূক্তি, যার জন্য একটি রিট মামলা হয়। এ ধরনের বক্তব্য প্রধান বিরোধী দলের নেতাও এর আগে দিয়েছিলেন, যা অনেককেই মর্মাহত করেছে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। যা হয়েছে, তা ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ দলীয় অন্যান্য নেতার পাল্টা রাজনৈতিক বক্তব্য। ধারণা করা হয়, রাজনৈতিক অঙ্গনেই এ বিতর্ক সীমিত থাকবে। তা না হওয়ার একমাত্র কারণ, ইসলামী রাজনৈতিক দলের কটূক্তি। এর বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রার্থনা করে একজন বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সংবিধান সংক্রান্ত কোনো না কোনো সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক হয়েছে প্রচুর। এখনো এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। এতে দোষের কিছু নেই। তবে আলোচ্য বক্তব্য বা কটূক্তি রাজনৈতিক শালীনতা অতিক্রম করেছে। আইনের সীমাও অতিক্রম করেছে।
একটি দৈনিক সংবাদপত্রের এ সংক্রান্ত শিরোনাম ছিল_'আদালত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে'। আদালতে সব সময়ই শুনানির সময় বাগ্যুদ্ধ হয়। বাদী ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা এ ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হন। এটাই স্বাভাবিক। অনেক সময় বিচারকের মন্তব্যের জন্যও সংশ্লিষ্ট আইনজীবী পাল্টা যুক্তি বা বক্তব্য প্রদান করে থাকেন। কখনো অশালীন বক্তব্য প্রদান করা হয় না। কর্মরত বিচারকরা সহনশীলতা ও ধৈর্যের সঙ্গে উত্থাপিত যুক্তিতর্ক শ্রবণ করেন। অধিকাংশ বিচারকই সহজে কোনো মন্তব্য করেন না। এ ক্ষেত্রে একজন বিচারক উপস্থিত ইসলামী দলের নেতাসহ বিরোধীদলীয় নেত্রী কটূক্তি করে রাষ্ট্রদোহিতার সমতুল্য অপরাধ করেছেন মর্মে মন্তব্য করেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যা ছিল অনভিপ্রেত এবং প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন।
বাংলাদেশসহ কোনো কোনো দেশের সংসদেও অনেক সময় উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তবে আদালতে এ ধরনের উত্তেজনা অনেক সময় হলেও তা বাগ্যুদ্ধের মধ্যেই সীমিত থাকে। কারণ, আদালত কখনো পেশিশক্তি প্রদর্শন বা বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে সরবে হৈচৈ করার জায়গা নয়। সংশ্লিষ্ট ঘটনায় যে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে, তা হলো, আদালতেও অশ্রাব্য শব্দ উচ্চারণ এবং প্রায় মারধর করার মতো পরিস্থিতি হতে পারে। জানা গেছে, এ ধরনের একটি ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। তবে তা পরবর্তী পর্যায়ে বেশি দূর গড়ায়নি। শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা হয়তো হয়েছে।
বর্তমান ঘটনার নিহিতার্থ একাধিক। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো, আদালত রাষ্ট্রীয় মূল তিনটি স্তম্ভের মধ্যে একটি প্রধান স্তম্ভ, যার মাধ্যমে সাংবিধানিক সুশাসন নিশ্চিত হয়। ইতিমধ্যেই মহাজোটভুক্ত অন্যান্য দলের নেতাসহ প্রধান বিরোধী দলের নেতারাও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ দেশে গণতন্ত্র নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হলেও এর মূল বিষয়গুলো খুব একটা আলোচনায় আসে না। স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেওয়া হয়, নির্বাচিত সংসদ ও সরকার প্রতিষ্ঠা করলেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। এ কথা ভুলে যাওয়া হয় যে, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। একটি কার্যকর সংসদসহ নিরপেক্ষ এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নির্বাহী অঙ্গও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি প্রয়োজন দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি। অন্তত জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে গ্রহণ না করলেই শুরু হয় সংঘাত।
যে সাংবিধানিক সংশোধনী নিয়ে এ ঘটনার সূত্রপাত, তা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে হয়নি। এর কারণ, একাধিকবার সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি প্রধান বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের আলোচনার জন্য আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তাঁরা কোনো সাড়া দেননি। এ বিষয়ে কোনো লিখিত মতামতও পাঠাননি। তাঁদের মূল বক্তব্য ছিল, আলোচনার আহ্বান লোক দেখানো মাত্র। অর্থাৎ, দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে আলোচনার রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ ধারা আজ নয়, বরং বহু দশক ধরেই বিদ্যমান। ফলে তথাকথিত সাংবিধানিক সুশাসন অবিরাম ব্যাহত হচ্ছে। কোনো বিষয়ে এক দল যদি বলে 'হ্যাঁ', তৎক্ষণাৎ অন্য দল বলবে 'না'। এতে যা-ই হোক, সাংবিধানিক সুশাসন হয় সুদূর পরাহত।
অন্য একটি নিহিতার্থ হলো, আইনজীবীদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে হবে। সংসদীয় রাজনৈতিক কাঠামোতে বহু দলের অস্তিত্ব অবশ্যই কাম্য। তবে আইনজীবীদের মধ্যে এ বিষয়টি কাম্য নয়। আইনজীবীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ব্যক্তিগত পর্যায়েই থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এই মতাদর্শ কখনো তাঁদের পেশাগত দায়িত্বকে প্রভাবিত করবে না বা করা সঠিকও নয়। অতীতে দু-একটি জনগুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় সব শ্রেণী ও মতবাদের আইনজীবীরা একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সফলতার নিদর্শন সমুজ্জ্বল করেছিলেন। এর মধ্যে দুইটি অন্যতম_১. ১৯৮৮ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ বাতিল ২. ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন।
উদ্ভূত পরিস্থিতির অন্য একটি বিষয় হলো উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়াকে বিতর্কের ঊধর্ে্ব রাখা। এখানেও সব দলের সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত হয়নি, যার প্রমাণ মিডিয়া সময় সময় দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করবেন_এটাই সবাই আশা করে। যুক্তিটি একপেশে মনে হলে এ কথাও বলা যায়, বার কাউন্সিলের নির্বাচিত কর্ণধাররা আইন পেশাসংক্রান্ত অধিকার অর্পণের বিষয়েও যত্নবান হবেন।
২ আগস্টের লজ্জাকর ঘটনা প্রবাহ এখনো সমাপ্ত হয়নি। গোলযোগ সৃষ্টিকারী ১৪ জন আইনজীবী বর্তমানে বিচারাধীন বা তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া দ্বিমুখী_১. হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছেন ২. পুলিশ ফৌজদারি মামলা করেছে। অন্যদিকে সিনিয়র আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অর্থাৎ আদালতের বাইরে একটি সমঝোতা। সমঝোতা এখনো হয়নি। স্বল্প সংখ্যক সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, যাঁরা বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট অধস্তন আদালতে রিমান্ডও প্রার্থনা করা হয়েছে। আইনজীবী সমিতি এবং অন্য দলীয় আইনজীবীরা ইতিমধ্যে একটি আলোচনাও করছেন। তবে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়নি। কিছু নিরপেক্ষ সিনিয়র আইনজীবী ঘটনার ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন।
কর্মরত বিচারক এবং উচ্চ আদালতের আইনজীবীদের মধ্যে সুসম্পর্কে মাঝেমধ্যে বিচারপতিসহ প্রখ্যাত আইনজীবীরাও বক্তব্যের মাধ্যমে গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন। এতে যে কোনো প্রভাব পড়েনি, তা সহজেই বোঝা যায়। উচ্চ আদালতসহ অধস্তন আদালতেও দুই পক্ষের শান্তিপূর্ণসহ অবস্থান সুবিচার সম্পন্ন করার জন্য অপরিহার্য। অধস্তন আদালতেও মাঝে মাঝে এর দারুণ অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রেও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন অশান্ত। প্রধান বিরোধী দল প্রায় অবিরাম ধারায় সংসদ বর্জনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশে রাজপথে তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের হুঁশিয়ারি প্রদানের ধারাও অবিরাম এবং অব্যাহত। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব এতে বিন্দুমাত্র চিন্তিত বা শঙ্কিত নয়। জনগণ কিন্তু চিন্তিত। ক্ষমতাসীন দলের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীও শঙ্কিত। তিনি অর্থমন্ত্রী, যার প্রধান দায়িত্ব হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা নিশ্চিত করা। সম্প্রতি এক বক্তব্যে তিনি অর্থনীতিতে তথা সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় কালো ছায়ার উপস্থিতির কথা বলেছেন। তাঁর দৃষ্টিকোণ এবং উপলব্ধি যে নিছক অর্থনৈতিক গণ্ডির মধ্যে সীমিত, তা নয়।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আগামী দেড় বছর এ ধরনের অস্থিতিশীলতা বজায় থাকলে জাতির সর্বমোট ক্ষতি হবে ২৫ বিলিয়ন ডলার। রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি। এ কারণেই অর্থমন্ত্রী চিন্তিত বা শঙ্কিত। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের প্রধানসহ কিছু সংখ্যক নেতার চিন্তিত বা শঙ্কিত হওয়ার কোনো চিহ্ন নেই। ব্যবসায়ী মহলসহ অর্থনীতিবিদরাও চিন্তিত। যে কালো ছায়া এবং বিপুল ক্ষতির বিষয়টি অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, তার মূল প্রভাব দৃশ্যমান হবে আগামী নির্বাচন-পরবর্তীকালে। ক্ষমতাসীন দল যদি ওই সময়ও নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়, তাহলে কিভাবে তারা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সমস্যা সামলাবে। এটা কি চিন্তার বিষয় হতে পারে না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.