এম. জে. আকবর-আরেকটি স্বাধীনতার সংগ্রাম

এটা স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায় এবং সবচেয়ে কঠিনতম অধ্যায়। প্রথমটি ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় পর্যায়টি ভারতীয় স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রাম। অতীত আর বর্তমানের এই সংগ্রামের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। আমরা এখনো স্বাধীনতা চেয়েই চলেছি। সেই চাওয়াটি বা সংগ্রামের কারণ হচ্ছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য।


আমরা কিন্তু নিভৃত পল্লীতে ক্ষুধার্তদের খোঁজ করি না। আমরা পাহাড়ি এলাকায়ও যাই না, যেখানে আমাদের মানুষগুলো লড়াই করে চলেছে। সেখানে আমরা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। আমরা সেখানে মানবাধিকারও লঙ্ঘন করে চলেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ক্ষুধার্তদের ব্যাপারে আমরা কোনো শব্দ করছি না।
মাওবাদীদের বন্দুকবাজি এখন শুধু গর্জনসর্বস্ব। এই গর্জন এখনো গণবিস্ফোরণে পরিণত হতে পারেনি। গরিবরা তাদের ভাগ্যকে মনে করে অনিবার্য হিসেবে। তারা এখনো রাজধানী দিলি্লর বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়। যাদের ভাগ্য কিছুটা ভালো, তাদের বাসস্থান হয় কোনো বস্তিতে। এখানকার গৃহহীন শিশুদের পরবর্তী পরিণতি কী? তাদের অনেকেরই ঠিকানা হয় কারাগারে। আর তিহার জেলখানায় থাকা এমন শিশুদের ৯০ ভাগেরই দ্বিতীয় কোনো জামা নেই। স্বাধীনতার ৬৫ বছর পর ভারতীয় শিশুদের এভাবেই কারাগারে ঠিকানা করে দিতে পেরেছে ভারত নামের শক্তিধর রাষ্ট্রটি। আমরা ১৯৪৭ সালে এমন স্বাধীনতাই অর্জন করেছি যে ভারতকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে লাখ লাখ মানুষকে হারাতে হয়েছে দুর্ভিক্ষের কারণে। আর এই দুর্ভিক্ষ কিন্তু বাংলা এবং পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার জন্য উত্তরাধিকার হিসেবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এই দুর্ভিক্ষ অর্জন করেছি ব্রিটিশের সেই অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণেই। এই মুহূর্তে ৫০ কোটি মানুষকে ২০ বছরেই স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত থাকতে হয়। স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও এই দেশের মানুষ দুর্ভাগা। ৪০ বছর বয়স পার না হতেই তাদের দাঁত পড়ে যায়। তারপর দ্রুতই বুড়িয়ে যায় এই জনগোষ্ঠী।
এই হচ্ছে স্বাধীনতা লাভের লড়াইয়ের ক্ষেত্র। এই ভূমিতেই যাঁরা আসছেন, তাঁদের যুগে যুগে এই সত্যকে উপলব্ধি করতেই হবে। শ্রেণী বিভাজন কিংবা জাত প্রথা যেন প্রশাসনেও সদম্ভে দণ্ডায়মান। এটা ওপরের স্তর থেকে নিম্নগামী। পাসপোর্ট অফিসের কেরানিবাবু শত রুপি না দিলে কাজ করবে না, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের বড়বাবু কাগজ হস্তান্তর বন্ধ রাখবেন উৎকোচ না পেলে। কনস্টেবল বাবুকে আর দোষ দিয়ে লাভ কি?
প্রতিটি জায়গায় দুর্নীতি মাথা উঁচিয়ে চলছে। আমাদের রাজপথগুলো একটু সামান্য বৃষ্টি হওয়ার পরও দেখা যায় যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে গেছে। দিলি্ল শহর কি পৃথিবীর একমাত্র নগরী, যেখানে বৃষ্টি হয়? লন্ডনের রাস্তা, ইস্তাম্বুল কিংবা সিঙ্গাপুরের রাস্তায় কিন্তু বৃষ্টি বোঝা যায় না। ওখানে তো মনে হয় প্রতিদিন বিকেলেই বৃষ্টি হচ্ছে।
স্বাধীনতার তালিকা যদি তোলা হয়, তাহলে সেটা হবে অনেক বড়। ভারতীয়রা মুক্তি চায়। মুক্তি চায় অসাম্য থেকে, ভণ্ডামি ও বর্বরতা থেকে। তোষামোদী এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়, তাকে মনে করা হতে পারে সবচেয়ে জঘন্যতম। আর দলীয় বিশ্লেষণ যদি করা হয়, তাহলে বলতে হবে, প্রতিটি দলই কমবেশি এই দোষে দুষ্ট।
১৫ আগস্টকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছিল যেই মহাত্মা গান্ধীর কারণে, তিনি স্বাধীনতার সেই আনন্দ উদযাপন করাজ জন্য দিলি্লতে দীর্ঘ অবস্থান করতে পারেননি। কারণ তাঁকে দৌড়ে আসতে হয়েছে কলকাতায়। যেতে হয়েছে, কারণ একটাই। ভারতীয়দের হাতে ভারতীয়দের জীবন দিতে হচ্ছিল বলেই। বেলগাছিয়ায় তিনি যখন হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন বিবিসির সাংবাদিকও। তাঁদের তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতার অনুষ্ঠান উদ্যাপনের চেয়ে এই মানুষগুলোকে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
১৯১৯ এবং ১৯২০ সালে গান্ধী একজন সুখী মানুষ ছিলেন। তিনি তখন জানতেন, যেকোনো সময় মানুষ জেগে উঠবে। একসময় তাঁর ধারণা হয়, স্বাধীনতা অর্জন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে তিনি কিন্তু ২৫ বছরের আগাম চিন্তা করতে পারতেন। আর ১৯৪৭ সালে এসে তিনি অর্ধশত বছরের দূরবর্তী কিছুও দেখার মতো ক্ষমতাবান ছিলেন। গান্ধী কিন্তু আধুনিক ভারতের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারতেন। কিন্তু তাঁকে প্রতিটি মুহূর্ত চিন্তা করতে হয়েছে ক্ষুধামুক্ত ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য।
লেখক : দিলি্ল থেকে প্রকাশিত দ্য সানডে গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদক দ্য ডন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা থেকে ভাষান্তর করেছেন মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.