এটি কি মৃত্যু, নাকি হত্যা?-দুর্ঘটনার সব কারণ খতিয়ে দেখতে হবে

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দুই নক্ষত্র তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে গোটা জাতি আজ শোকে মুহ্যমান। সড়ক নামের মৃত্যুফাঁদ তাঁদের দুজনকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। সেই সঙ্গে কেড়ে নিয়েছে আরো তিনটি প্রাণ। আর এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে প্রগতিশীল ও মুক্তমনা সংস্কৃতিচর্চার এক কঠিন সংগ্রামকে, সুস্থধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের এক অসামান্য প্রয়াসকে।


এই মৃত্যুকে আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এটি কি মৃত্যু, নাকি হত্যা_এই প্রশ্ন আজ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মেধা, মুক্তবুদ্ধি ও সৃজনশীলতার অভাব যখন চরমে পেঁৗছে গিয়েছিল, তখনই আবির্ভাব ঘটেছিল তরুণ চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদের। তাঁর নির্মিত 'মুক্তির গান', 'মাটির ময়না', 'অন্তর্যাত্রা' ইত্যাদি ছবি দেশে ও বিদেশে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে। 'মাটির ময়না' চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছিল। এ ছাড়া চলচ্চিত্রটি প্রায় এক ডজন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখা বন্ধ করে দিয়েছিল, তারাও 'মাটির ময়না' দেখতে আবার প্রেক্ষাগৃহে ফিরে গিয়েছিল। তিনি তাঁর চলচ্চিত্রে মাটি ও মানুষের কথা তুলে এনেছেন, মানবিক মূল্যবোধের কথা বলেছেন। তাঁর চলচ্চিত্র কেবল চলচ্চিত্রই ছিল না, এর মাধ্যমে তিনি সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক সফল সংগ্রামেরও সূচনা করেছিলেন। তাই তিনি জঙ্গি ও মৌলবাদীদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতেও পরিণত হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক জগতের আরেক নক্ষত্র মিশুক মুনীর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ও সফল নাট্যকার শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর যোগ্য সন্তান।
আমাদের সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা এতটাই বেহাল হয়ে পড়েছে যে মহাখালী থেকে উত্তরাঞ্চলের ১২টি জেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি সড়কগুলোতে খানাখন্দ পেরিয়ে কোনো রকমে গাড়ি চলাচল করে। সড়কের যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আছে ট্রাফিক পুলিশ। অথচ বিভিন্ন জরিপে বলে দেশের ৫০ শতাংশ গাড়িচালকের কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই। ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি। এসব যানবাহনের অধিকাংশেরই ব্রেক সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করে না। অথচ বিআরটিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনগুলো বিআরটিএ থেকে 'ফিটনেস সার্টিফিকেট' বা মানুষ মারার সার্টিফিকেট পেয়ে যায়। অভিযোগ আছে, ট্রাফিক পুলিশের হাতে সামান্য 'নজরানা' দিয়ে ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে, এমনকি লাইসেন্স ছাড়াও গাড়ি চালানো যায়। এগুলো বন্ধ করা না গেলে, পরিকল্পিতভাবে সড়কগুলোর উন্নয়ন করা না গেলে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে বরং বাড়তেই থাকবে। দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার থাকতে কতকাল এই সড়ক দুর্ঘটনা চলতেই থাকবে। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেরই যোগাযোগমন্ত্রী এ পরিস্থিতির দায় নিয়ে পদত্যাগ করতেন। কাজেই সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ যে কজন মারা গেলেন তাঁদের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী, তা আজ অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি, এটি কি কেবলই সড়ক দুর্ঘটনা, নাকি দুর্ঘটনার মাধ্যমে তাঁদের হত্যার কোনো ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়েছে_সেটিও তদন্ত করে দেখতে হবে। মাইক্রোবাসের চালকের সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, তার সঙ্গে কোনো জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগ ছিল কি না এবং এটি কোনো আত্মঘাতী হত্যাকাণ্ড কি না?

No comments

Powered by Blogger.