কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

১৪ আগস্ট ১৯৭৫। দিবাগত মধ্যরাত। দিন শেষের ক্লান্তি শরীরে নিয়ে জগন্নাথ হলের উত্তর ভবনের ৫০ নম্বর কক্ষে ফিরছি। টিএসসির মোড় থেকেই দেখলাম অদূরে উপাচার্য ভবনের সমানের রাস্তায় লাইটপোস্টের আলোর নিচে কারা যেন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। কলাভবনের প্রধান গেটের কাছে তখন একটাই ল্যাম্পপোস্ট ছিল।


ঢাকার রাস্তায় তখন আজকের মতো রাতভর ঝলমলে আলোর প্রাচুর্য ছিল না। কাছে এগিয়ে দেখলাম, আলো-আঁধারির ভেতর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ছাত্র রাস্তায় আল্পনা আঁকার চেষ্টা করছেন। নেতৃত্বে শেখ কামাল। পরদিন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা। তাঁকে বরণ করতেই প্রধানমন্ত্রীর পুত্র নিজ উদ্যোগে আর দশজন সাধারণ ছাত্রের সঙ্গে রাত দুপুরে রাস্তায় আল্পনা আঁকায় নির্ঘুম ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করছেন। সামান্য একটা কাজে প্রধানমন্ত্রী পূত্রের উপস্থিতি কি জরুরি ছিল! নিজে সশরীরে না থাকলে কি কাজটা হতো না! ব্যাপারটা আমাকে আজও ভাবায়, তাড়িত করে। এ কালের ছাত্রনেতারা ব্যাপারটা কল্পনাতেও আনতে পারবেন না। দেশে তো এমন প্রধানমন্ত্রী পুত্রদেরকেও আমরা দেখেছি, যাদের নিষ্ঠুর দাপটে বাঘে-ছাগলে এক ঘাটে জল খেয়েছে। হাওয়া ভবনের সিংহাসনে বসে চালিয়েছে বর্বর ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড। দেখেছি ক্ষমতার অপব্যবহার।
'দেশি, রুমে যাও। রাইত হইছে, কাইল ম্যালা কাজ আছে।' সামান্য দূর থেকে আমার উদ্দেশে বলা ব্যস্ত শেখ কামালের কণ্ঠ নিঃসৃত উচ্চ স্বরের উচ্চারণগুলো আজও আমার কানে বাজে। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে আরো জেনেছিলাম, সেই রাতে হয়তো তিনি ৩২ নম্বরে ফিরবেন না। এসএম হলের রুমে ফ্রেশ কাপড়চোপড় রাখা আছে, সকালবেলা সেগুলো গায় চড়িয়েই ক্যাম্পাসে চলে আসবেন। কিন্তু তিনি ৩২ নম্বরের অতি চেনা ঘরেই ফিরে গিয়েছিলেন সেই রাতে এবং রাত শেষে ভোরের আলো ফোটার আগে পিশাচের নিষ্ঠুরতার নির্মম আক্রমণে নিরস্ত্র তিনি পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে গেলেন। আজও আমার চোখে ভাসে মাত্র ঘণ্টা কয়েক আগে সেই রাতের শেষ দেখা সুদর্শন শেখ কামালের হাস্যোচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত চেহারা। কানে বাজে_'ম্যালা কাজ আছে।' এই শেষ কথাটিকে ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আমার কাছে খুবই তাৎপর্য ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। জাতীয় পরিসরে সামান্য এই কথাকে বিশ্লেষণ করতে গেলে বুঝি যে কাজ এখনো শেষ হয়নি। যে আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর, তা আজও আমরা গড়তে পারিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের কর্মযজ্ঞ সফলতা পেলে হয়তো শেখ কামালের স্বপ্ন অনেকাংশেই পূর্ণতা পাবে।
আমরা পরস্পরকে 'দেশি' বলে সম্বোধন করতাম। ১৯৬৮সালে গোপালগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সম্মেলন উদ্বোধন করতে কেন্দ্রীয় নেতা তোফায়েল আহমদের সঙ্গী ছিলেন শেখ কামাল। সেই থেকে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। তিনি তখন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। আমি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে একই শ্রেণীতে। সেই দিন থেকেই আমরা পরস্পরের কাছে 'দেশি' ছিলাম। তারপর রাজনীতি, খেলাধুলা, নাটক ইত্যাদি কাজে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়ে পরস্পরের বন্ধু হয়েছি। বন্ধু হিসেবে শেখ কামাল যে কতখানি উদার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ের কথা না হয় বাদই দিলাম, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সন্তান হয়েও তিনি যেভাবে সমমনা, সাধারণ বন্ধুদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত মেলামেশা করেছেন, তা আমার মতো অনেকের স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট ও উজ্জ্বল। সমস্যাগ্রস্ত কেউ তাঁর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পেয়ে ফিরে এসেছেন_এমন কথা সেই কালের কেউ বলবে বলে বিশ্বাস হয় না।
একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার গঠন করার পর আমরা প্রথম নাট্যপ্রদর্শনী করেছিলাম তখনকার ডিআইটির উল্টোদিকে ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রায় ভাঙাচোরা মিলনায়তনে। স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে মিলনায়তনটিকে মোটামুটি নাট্য প্রদর্শনীর উপযোগী করা হলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, দর্শকদের বসার জন্য কোনো ডেকোরেটরের কাছেই চেয়ার ভাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। অগত্যা সমস্যা সমাধানে আমরা ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলাম, নাট্যসহকর্মী শেখ কামাল যদি সমস্যা সমাধান করে দিতে পারেন, এই প্রত্যাশায়। শেখ কামাল সে যাত্রায় আমাদের উদ্ধার করলেন পরিচিত এক ডেকোরেটরকে অনুরোধ করে। তিনি আদেশ দিলেই পারতেন, কিন্তু ডেকোরেটরকে অনুরোধ করার সেদিনের বিনয়ী ভঙ্গিটি আজও মনে পড়ে। আজকাল যাঁরা মন্ত্রী-পাতিমন্ত্রী কিংবা তস্য জুনিয়র নেতাদের ছেলেমেয়েদের দাম্ভিক এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে অভ্যস্ত, তাঁরা অসীম ক্ষমতাধর বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামালের বিনয় এবং ভদ্রতাজ্ঞান সম্পর্কে ধারণাও করতে পারবেন না। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা এখনো জীবিত আছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে শ্রদ্ধাস্পদদের প্রতি শেখ কামালের আচরণ কতখানি খাঁটি ও সৎ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি, জাতির পিতার পুত্র হিসেবে তিনি সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টে কখনো বিন্দুমাত্র বাড়তি সুবিধা নেননি অথবা কাউকে সুবিধা প্রদানের সুযোগও দেননি। শেখ কামালকে রাজনীতিক বানিয়ে অথবা বঙ্গবন্ধুর পুত্র হিসেবে বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত দেখিয়ে পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে যারা তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করেছে, তারা গর্হিত অন্যায় করেছে। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং শেখ কামালের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর পেছনে যে দুরভিসন্ধি, তা যে বাঙালি জাতিসত্তার চিরায়ত শোভন সংস্কৃতির ওপর আঘাত, তা আজ বোধহয় সবাই বুঝতে পারেন। শেখ কামাল রাজনীতিক ছিলেন না, তবে রাজনীতিকের অধিক ছিলেন। আমার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ তাই বলে। তিনি যে রাজনীতি বিষয়ে গভীর সচেতন ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথাগত রাজনীতির বাইরে তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই মতো কাজও করেছেন। ক্রীড়া ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তাঁর নিবিড় সম্পৃক্ততা নিছক আবেগের তাড়না ছিল না। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশকে তিনি সামগ্রিকভাবে সামনে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। এ ব্যাপারে গভীর তলদেশস্পর্শী নিজস্ব ভাবনা ও মতও ছিল তাঁর। সেই তাড়না থেকেই বোধ হয় দশদিগন্তের মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভালোলাগার সম্পর্ক সৃষ্টিতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। প্রথাগত দলীয় রাজনীতির সীমারেখা ডিঙিয়ে তিনি সবাইকে নিয়ে গড়েছিলেন নিজস্ব ভূবন। সে ভূবনের সবাই যে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের ছিলেন তা বলা যাবে না। তবে তাঁর শুভ কর্মপথে যে তাঁদের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল তা বলতে দ্বিধা করি না। এসব কারণেই বোধ হয় ১৫ আগস্টের ভোরে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ওপর ঘাতকদলের প্রথম আঘাত শেখ কামালের উদার বুকেই লেগেছিল। তারপর একে একে পিতা-মাতা, বধূ-ভ্রাতা-ভ্রাতৃবধূ। কী বীভৎস, কী কুৎসিত, কী নিদারুণ সে ঘটনা। শুধু বাঙালি জাতির কেন, বিশ্ব ইতিহাসেও এ রকম নৃশংসতার নজির খুঁজে পাওয়া ভার। পঁচাত্তরের সেই অমোচনীয় কলঙ্কের পর এক এক করে দিন গড়িয়েছে। দিন গড়িয়ে বছর। জমেছে জঞ্জালের পাহাড়। বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালের মেলা কাজ এখনো শেষ করে ওঠা হয়নি।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.