জনস্বার্থ-জাতীয় সংসদ, বিমানবাহিনী এবং মেট্রোরেল by সৈয়দ বদরুল আহসান

মেট্রোরেল নিয়ে আমরা বিপাকে পড়েছি। এবং এ বিষয়ে স্বয়ং জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ আমাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে প্রস্তাবিত মেট্রোরেল সংসদ এলাকার মধ্য দিয়ে তৈরি করা হোক, এটা তিনি মেনে নেবেন না। আমরা তাঁর এই বক্তব্য শুনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি এবং আশা করি যে তিনি বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তাঁর দৃঢ়তা বজায়


রাখবেন; এবং সেটা তিনি করলেই আমাদের সবার মনে আবার আস্থা ফিরে আসবে—সেই আস্থা, যা সুদূর কোনো অতীতে আমরা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে পেতাম। ভাবতে অবাক লাগে যে এই দেশে কোনো একসময় ছিল, যখন রাজনীতির অর্থই ছিল মানুষের সেবা করা। শেরেবাংলা, বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানী ও তাঁদের অনুসারীরা বছরের পর বছর গোটা দেশ ঘুরে দেখেছেন এবং সাধারণ মানুষ তাঁদের নিজেদের মধ্যে পেয়ে মনের ভেতরে আশার সঞ্চার করেছে। আজ সেই রাজনীতি নেই। আছে পরিবার; এবং এসব পরিবার বরাবরই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কী করে তারা এই দেশের কর্তৃত্ব নিজ হাতে রাখবে, কুক্ষিগত করবে। আপনি আওয়ামী লীগই বলুন আর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলই বলুন—সর্বত্র এই পারিবারিক বিষয়টি কাজ করে চলেছে।
কিন্তু এটা ধরে নেওয়া ভুল হবে যে রাজনীতি কেবল পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। একটু ভেবে দেখুন, আপনার আশপাশে যেসব রাজনীতিক রয়েছেন, এঁদের মধ্যে প্রকৃত রাজনীতিকের সংখ্যা কত। একটা সময় ছিল, যখন এ অঞ্চলের এই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে খ্যাতিমান আইনজীবীদের প্রাধান্য ছিল এবং ছিল বলেই মানুষ নানা সময়ে বিভিন্ন রকমের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করেছে। এর ফলে আমরা সবাই বেজায় উপকৃত হয়েছি। ইতিহাস ও কৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের চিন্তাভাবনা ও ধ্যান-ধারণার বিকাশ ঘটেছে। এসব রাজনৈতিক ব্যক্তি আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। এই স্বপ্নগুলো তাঁরাই আমাদের মন-মননে সাজিয়ে তুলেছিলেন। সেই রাজনীতিবিদ আজ নেই, সেই স্বপ্ন অনেক দিন হলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এই হওয়ার পেছনে অবশ্য কারণও রয়েছে। সেই কারণগুলো খুঁজে পাবেন, যদি আপনি বর্তমান জাতীয় সংসদের সদস্য তালিকা পরীক্ষা করেন। প্রার্থীদের নিজেদের ঘোষণা অনুযায়ীই নবম জাতীয় সংসদের প্রায় ৫৭ শতাংশ সাংসদই হচ্ছেন ব্যবসায়ী। সমস্যাটি তাহলে কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ—একজন ব্যবসায়ীর শ্রেণী-চরিত্র একটাই। তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থই মুখ্য করে দেখবেন। এ তো গেল ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের কথা। আবার দৃষ্টি ফেরান জাতীয় সংসদের দিকে। সাংসদদের একটি বড় অংশ হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। সাংসদ তাঁরা হতে পারেন অবশ্যই; এবং হয়েছেনও। তবে জাতীয় ইতিহাসে, দেশের উন্নয়নে তাঁদের অবদান কি কখনো উল্লেখযোগ্য হয়েছে? আপনি উত্তর খুঁজতে খুঁজতে লক্ষ করুন যে সংসদে ছায়াছবি ও নাট্যজগতের কোনো একসময়ের নায়ক-নায়িকারাও রয়েছেন। গানের শিল্পীও আছেন। এসব গোত্রের মধ্যে কোনো প্রকৃত রাজনীতিক আপনি খুঁজে পাবেন না। আর যে-সংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তি রয়েছেন, যত দিন অতিবাহিত হচ্ছে, তাঁদের সংখ্যা ততই কমে আসছে।
আমাদের জীবনে রাজনৈতিক নেতা না থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ যে খুব একটা আনন্দদায়ক হবে, সেটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। স্পিকার আবদুল হামিদ হচ্ছেন সেই পুরোনো রাজনীতির ধারায় গড়ে ওঠা মানুষ, যাঁর মধ্যে আমরা এখনো আমাদের হূদয়ের অনুভূতিগুলো প্রকাশ হতে দেখি। এই কাজটি তো প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা করতে পারতেন। তাঁরাই তো আমাদের আশ্বস্ত করতে পারতেন যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী মেট্রোরেলের ব্যাপারে যে আপত্তি তুলেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে, হোক না সেই গণতন্ত্র দুর্বল ও রক্তহীন, মানুষ এটাই আশা করে যে সরকার সর্বক্ষেত্রে দৃঢ়তার পরিচয় দেবে। বিমানবাহিনী তার আপত্তির কথা বলেছে এলাকার নিরাপত্তার কথা ভেবে। খুবই ভালো কথা। সে বিষয় না হয় সরকারি মহলে আরও ভালো করে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। আবার না-ও করা যেতে পারে, যদি সরকার মনে করে যে মেট্রোরেল স্থাপনের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা অপরিবর্তিত থাকবে। একটি প্রজাতন্ত্রে সব ক্ষমতা নির্বাচিত সরকারের হাতে ন্যস্ত। আর সেই ক্ষমতাবলে সরকার জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে থাকে। যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেই সিদ্ধান্ত বজায় থাকবে এবং কোনো চাপের মুখে পরিবর্তিত হবে না। এই হলো রীতি। তার চেয়ে বড় কথা, কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান কোনো প্রেশার গ্রুপে পরিণত হবে না এবং কোনো সরকারকে বাধ্য করবে না এমন কোনো কিছু করতে, যাতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বিনষ্ট হয়।
আমাদের বক্তব্য একটাই আর তা হলো, যে পরিকল্পনা মেট্রোরেলের বিষয়ে নেওয়া হয়েছে, সেটি বজায় রাখা হোক। কোনো ক্রমেই যেন জাতীয় সংসদ এলাকায় এই প্রকল্পের ছায়া না পড়ে—এবং তা হলো দুটি কারণে। প্রথমত, জাতীয় সংসদ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান, যার দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এবং দেশে আইন প্রণয়ন করা হয়। অতএব, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, তা নির্বাহী বিভাগই হোক আর বিমানবাহিনীই হোক, জাতীয় সংসদের এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সংসদ এলাকার একটি বিশেষ স্থাপত্য রয়েছে, যা এলাকার নান্দনিক পরিবেশকে তুলে ধরে। বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই কানের বিশ্বনন্দিত কীর্তি এই সংসদ ভবন, সেটাও যেন আমরা মনে রাখি। বিগত কয়েক বছরে অবশ্য এই সৌন্দর্য অনেকাংশে বিঘ্নিত হয়েছে। যাঁরা সেই ১৯৮১ সালে অতি উৎসাহী হয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানের মরদেহ চন্দ্রিমা উদ্যানে সমাহিত করেন তাঁরা একটুও ভাবেননি, কী নিদারুণ কাজটি তাঁরা করছেন। আজ আপনার ওই লেকের ধারে যেতে মন চায় না। গোটা চন্দ্রিমা উদ্যানটি মনে হয় একটি গোরস্থানে রূপান্তর করা হয়েছে। আবার কয়েক বছর আগে সংসদ এলাকায় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের জন্য বাসভবন তৈরি করতে গিয়ে এলাকার আরও কিছু ক্ষতি করা হয়েছে। এখন যদি মেট্রোরেলও সেখানে অনুপ্রবেশ করে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের এ-ও দেখতে হবে যে গোটা জায়গাটি একটি বাণিজ্যিক স্থানে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে ঢাকা শহর এমনিতেই একটি বৃহৎ বস্তিতে পরিণত হয়েছে। তাই বলে অবশিষ্ট সৌন্দর্য যা আছে, সেটা আমরা ধ্বংস করে ফেলব কেন?
সবশেষে একটি কথা বলার সময় বোধ হয় এসেছে। বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় সামরিক খাতে কত অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সে বিষয়টি জনগণের সামনে কখনো তুলে ধরা হয়নি। যে গণতান্ত্রিক পরিবেশে অন্য সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা হয়, বিতর্ক হয়, সেই একই পরিবেশে আমাদের সামরিক বাহিনী-সম্পর্কিত বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আলোচিত হওয়া দরকার। জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারটি অবশ্যই থাকবে। তার চেয়ে বেশি জরুরি হলো সমগ্র জাতিকে সব বিষয়ে অবহিত করা।
আর এই যে আজ পর্যন্ত এই বাংলাদেশে আমরা কোনো প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাইনি, যে-ই সরকারপ্রধান হয়েছেন, তিনিই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিজেকে রেখেছেন—এ ধারাটি বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। একই সঙ্গে যে অভিনব পদ্ধতিতে জেনারেল এরশাদের সরকার সেনাবাহিনী বিভাগ গড়ে তুলেছিল, সেই পদ্ধতি গুটিয়ে ফেলার সময়ও এসেছে। কাজটি ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরেই করা প্রয়োজন ছিল। কেন সেটা করা হলো না, সেই ব্যাখ্যা খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা কোনো দিন জাতির কাছে পেশ করেননি। ফলে ওই পুরোনো নিয়মেই কাজ হয়ে আসছে। আবার সেটাই বা বলি কী করে? বিভাগটি থাকার কারণে স্বয়ং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে, যা মোটেও আমাদের কাম্য নয়।
অনেক ভাবনার কথা বলা হলো। অনেক উদ্বেগ প্রকাশিত হলো। এখন প্রয়োজন গণতন্ত্রের স্বার্থে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া। আর হ্যাঁ, জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদের প্রতি শ্রদ্ধা বরাবরই আমাদের ছিল। এখন সেই শ্রদ্ধা নিঃসন্দেহে আরও ব্যাপক আকার ধারণ করল।
সৈয়দ বদরুল আহসান: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.