গন্তব্য ঢাকা-ঢাকায় কি আর সাধে থাকি?

প্রাথমিক সৌজন্যমূলক কথাবার্তা সেরেই প্রশ্ন করি লোকটিকে, ‘কী নাম আপনার, বলবেন?’ ‘নজরুল।’ নিস্পৃহ স্বরে একটা শব্দ বলেই দাঁড়ি টেনে দেন তিনি। নাছোড়বান্দা আমি আবার প্রশ্ন করি, ‘শুধুই নজরুল? আগে-পরে আর কিছুই নেই?’ জবাব নেই। একমনে নিজের কাজ করে চলেন তিনি।
‘দেশের বাড়ি কোথায় আপনার?’ ‘দ্যাশের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। চৌহালী থানা আছে না? সেই থানাতে।’ ‘আর গ্রামের নাম?’ ‘বিরিদাশুরিয়া গ্রাম।’ ‘গ্রামে যান না?’ এবার একটু লাজুক হাসি ফোটে লোকটির ঠোঁটের কোণে, ‘১০-১৫ দিন গেলেই বাড়ি চলে যাই। থাকতে পারি না এখানে বেশি দিন। ঢাকা বেশি দিন সইতে পারি না।’ জানতে চাই, ‘এই আখ বিক্রির ব্যবসা কত দিনের?’ আবারও যেন একটু লজ্জা এসে ঘিরে ধরে তাঁকে। ‘মাত্র দুই দিন হইছে। ৮ তারিখ (৮ সেপ্টেম্বর ২০১১) থেকে এখানে এই ব্যবসা করছি। আগে রিসকা (রিকশা) চালাইতাম। রিসকা চালানোর চাইতে এই কাম ভালো। নিজের আকাঙ্ক্ষা মতোন কাম করা যায়। আর রিসকা চালাইলে তো সারা দিনই কষ্ট করতে হয়।’ ‘তাহলে একেবারে আখের রসের ব্যবসাটা করলেই তো পারতেন? লাভটা একটু বেশিই থাকত।’ ‘তা ঠিক। কিন্তু গাড়ি কিনতে হইব, মেশিন কিনতে লাগব। অত টাকা এহন হাতে নাই। গোটা গোটা গেন্ডারি বিক্রির ব্যবসাটা একটু কম টাকাতেই হয়।’ হতাশার রেখা তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট।
কথার মোড় ঘুরাই আমিই। ‘গ্রামে গেলে কেমন মজা করেন?’ এবার একটু উচ্ছ্বাস দেখা যায় তাঁর আচরণে। বলেন, ‘গ্রামে আনন্দ তো হবেই। ছোটবেলায়ও যেমন মজা করছি, বড় হয়েও তেমনই। মাছ-মুছ ধরছি, নদীতে সাঁতার কাটছি, হাটবাজার করছি। এই আর কি! সেগুলা করতেও ভালো লাগে।’ ‘আর ঢাকায় কেমন লাগে?’ মনে হয় এবার বেশ সমস্যায় পড়ে যান তিনি। বলেন, ‘ঢাকা কি আর সাধে ভালো লাগে? মনে করেন, ঢাকায় থাকলে যেটুকু কামাই (আয়) করি। সেটা দিয়েই বৌ, বাচ্চা চলে। এখানে থাকলে তাই ভালো লাগে। আবার গ্রামে গেলে মা, বৌ রেন্ধে-বেড়ে খাওয়ালে খুব ভালো লাগে। এখানেও আমার অনেক বন্ধু আছে, কিন্তু গেরামে আমাগো আড্ডা আরও বেশি।’ এবার নিজের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন তিনি। ‘গ্রামে আমাদের তেমন জমি-জায়গা নাই। যা একটু ভিটাবাড়ি আছে তাই। যমুনা নদীর পরেই আমাদের বাড়ি। আমরা নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করতাম। আর নিজেরাও গাঙের মাছ খাইতাম। বাড়িতে যা রান্ধে তাই ভালো লাগে। তয় গাঙের (নদী) মাছ দিয়ে ভাত খাইতে টেস্ট বেশি। মাছ ধরতে গিয়া তিনবার নদীতে ডুবছি। গ্রামের মানুষ বলে বাঁচছি। একবার রাতের বেলা মাছ ধরতে গিয়া মাঝনদীতে গিয়াই শুরু হইছে ঝড়। নৌকা উল্টাই গ্যাছে। সাঁতার দিয়ে তবে তীরে আসছি।’
গল্প করতে করতে জানা হয়ে যায় তাঁর জীবনের বেশ কিছু অংশ। নজরুলেরা তিন ভাই ও দুই বোন। মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে তাঁর ছোট্ট যে সংসারটি গ্রামের বাড়িতে আছে; তাদের ছেড়ে এই শহরে থাকতে একটুও ভালো লাগে না তাঁর। তবু থাকতে হয়। ওদের জন্য অনেক কিছু করতে ইচ্ছা করে। বলেন, ‘দায়িত্ব তো অনেক করতে মন চায়। কিন্তু তেমন কিছুই করতে পারি না। দুই ছেলে এক মেয়ে আমার। অরা তো এখনো পড়ার যোগ্য হয় নাই। টাকার জন্য আমার পড়ালেখা হয়নি। ইচ্ছা আছে, অদের অনেক পড়ামু।’
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনের রাস্তায় কয়েক দিন ধরে কিছু টাকা আয়ের উদ্দেশে একটা ভ্যানগাড়িতে কিছু আখ নিয়ে বসেন তিনি। মন্দিরে আসা দর্শনার্থী বা অন্যরা পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কিনে নেয় গেন্ডারি। দাম দিতে হয় মাত্র পাঁচ বা দশ টাকা প্রতি পিস। সকালে ভ্যানে করে শ্যামবাজার থেকে আখ নিয়ে আসেন নজরুল। তারপর সারা দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি করেন। গত দুই দিনে লাভ ছিল প্রায় ৩০০ টাকার মতো। নতুন এই ব্যবসাটা দিয়ে তিনি যেন ঝালিয়ে নিতে চাইছেন নিজের জীবন। জীবন অন্যদিকে বাঁক নেয় কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বলেন, ‘যদি দেখি কামাই দিয়ে কুলাইতে পারছি না, তাহলে আবার এই ব্যবসা ছেড়ে রিসকা চালাইতে শুরু করমু।’ কথা বলতে বলতে আখ চেঁছে পরিষ্কার করা, টুকরো টুকরো করে কাটার কাজে আবার তিনি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কী নিপুণভাবে কাজটা করেন তিনি! ধীরে ধীরে মসৃণ হয়ে ওঠে আখের গা। যদিও কাজটা করতে গিয়ে তাঁর হাত, পা, কাপড় ধুলায় ভরে ওঠে। তবে আখটি খাবার উপযোগী করে তুলে তাঁর নিজের জীবনের চলার পথটা যদি মসৃণ হয়ে ওঠে, তাহলেই তিনি মহাখুশি।
 শর্মিলা সিনড্রেলা

No comments

Powered by Blogger.