আনাড়ি পদক্ষেপের খেসারত দিলেন নাশিদ-মালদ্বীপে অভ্যুত্থান by বি. রমন

বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর একদল সদস্যের যোগদানের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগে বাধ্য করানো অবশ্যই নিন্দনীয়। তবে এ জন্য প্রেসিডেন্ট নাশিদও কম দায়ী নন। তিনি বিষয়টিকে নিয়ে আনাড়ির মতো নাড়াচাড়া করেছেন মালদ্বীপে পুলিশ ও জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর (এমএনডিএফ) একশ' জনের মতো কর্মকর্তা বিদ্রোহ করে আন্দোলনরত বিরোধী দলের সঙ্গে হাত মেলানোর পর গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে


নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। অপরাধ আদালতের প্রধান বিচারককে প্রেসিডেন্টের নির্দেশে গত ১৬ জানুয়ারি জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেফতার করার পর থেকে রাজধানী মালেতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছিল। গ্রেফতারের কারণ হিসেবে ওই বিচারকের কর্মকাণ্ডকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়। বিক্ষোভকারীরা এবং পুলিশ ও এমএনডিএফের বিদ্রোহী অফিসাররা জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদর দফতরে হামলা চালায় ও ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক দলের সদর দফতরে অগি্নসংযোগ করে। তারা সরকার পরিচালিত স্থানীয় রেডিও-টিভি অফিসও দখলে নেয়। সেখান থেকে তারা প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগের আহ্বান জানায়। নতুবা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলা চালানোর হুমকি দেয়। এরপর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত রেডিও-টিভিতে সম্প্রচারিত এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতির মাধ্যমে তার পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন।
বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট বলেন, 'আমি শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাই না বলে পদত্যাগ করছি। আমি মনে করি, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে শক্তি প্রয়োগ করতে হতো এবং এতে অনেক বেসামরিক নাগরিকের ক্ষতি হতো। আমি মালদ্বীপের জনগণের সুন্দর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কামনা করি।'
তার পদত্যাগের পরপরই ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ ওয়াহিদ মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণের পর ড. ওয়াহিদ টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলেন। দেশের সংবিধান রক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। দেশে যথার্থভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আইনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কিছু বলার জন্য তিনি পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী বা কাউকে নির্দেশ দেবেন না বলেও তিনি অঙ্গীকার করেন। প্রত্যেকে সংবিধান ও আইনি সুরক্ষা পাবেন বলেও তিনি ঘোষণা করেন।
বিদায়ী প্রেসিডেন্ট নাশিদ ও তার পরিবারকেও আইনি সুরক্ষা দেওয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি সব রাজনৈতিক দল, মালদ্বীপের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও জনগণকে ব্যক্তিগত ঘৃণা এবং ঈর্ষাপরায়ণতা ভুলে জাতীয় স্বার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং জনগণের বৈরিতামুক্ত ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
জানুয়ারিতে সরকার অযোগ্যতা ও অদক্ষতার অভিযোগে বিচার বিভাগ পুনর্গঠনের ঘোষণা দেওয়ার পর পরিস্থিতির নাটকীয় মোড় নেয়, যার পরিণতিতে নাশিদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
১৬ জানুয়ারি নিরাপত্তা বাহিনী অপরাধ আদালতের প্রধান বিচারক আবদুল্লাহ মোহাম্মদকে গ্রেফতার করে কাফু আতোল গিরিফুসিতে প্রশিক্ষণ ফ্যাসিলিটিতে এনে রাখে। সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটিতে বিষয়টি বিরোধী দল উত্থাপন করে। তখন কমিটিতে এক বিবৃতির মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান, বিচারককে গ্রেফতার করা হয়নি। তাকে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। গ্রেফতারের কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের বারবার করা অনুরোধকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারকের বিরুদ্ধে গোটা অপরাধ আদালতকে কব্জা করে নেওয়ার অভিযোগ তোলেন এবং নির্বাহী বিভাগ সংবিধানকে রক্ষা করার স্বার্থেই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী উল্লেখ করেন, ১৬ জানুয়ারিতে পুলিশ সেনাবাহিনীর কাছে একটি অনুরোধপত্র পাঠায়। ওই পত্রে পুলিশ আইনের ৭১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বৈধ দায়িত্ব পালনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। বলা হয়, অপরাধ আদালত পুলিশের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করছে না, বিচারক মোহাম্মদ পুলিশের কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করছেন এবং এর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে ও পুলিশ জননিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারছে না।
সংবিধানের ৯ অধ্যায় ও ২০০৮ সালের সামরিক বিধি অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনী প্রধান বিচারককে বন্দি করে। বিচারকের আটক অসাংবিধানিক_এ কথা প্রতিরক্ষামন্ত্রী অস্বীকার করেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন, যাদের চলমান ঘটনার কারণে আটক করা হয়েছে তাদের আদালতের মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং এই ঘোষণার পর হাঙ্গামা-হুজ্জত নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
ক্ষমতাসীন মালদ্বীপ গণতান্ত্রিক পার্টি আদালত আইন সংশোধনের প্রস্তাব করে। এটি পাস হলে সুপ্রিম কোর্টের উভয় ব্রাঞ্চ ও হাইকোর্টের বিচারকের সংখ্যা কমে যেত।
সংসদের নিরাপত্তা কমিটিতে প্রধান বিচারকের গ্রেফতার নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় এমপিদের মধ্যে উত্তেজনাকর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের পর জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির অধিবেশন আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং বিচারকের মুক্তি দাবিকারী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থকদের সহিংস সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল গত ৪ ফেব্রুয়ারি এবং ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এটা অব্যাহত থাকে। ৭ তারিখ সকালে একশ' জনের মতো পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসার বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টকে তারা পদত্যাগ করিয়েই ছাড়ে। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের পর আটককৃত বিচারক মুক্তি পান।
তবে এবারকার পরিস্থিতি ১৯৮৮ সালের পরিস্থিতির চেয়ে ভিন্ন। সেবার বাইরের শক্তি হিসেবে তামিল বিদ্রোহী সমর্থিত শক্তি জড়িত থাকার কারণে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সেটা ক্ষতির কারণ হতে পারত। সে কারণে মালদ্বীপের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ওই ক্যু প্রচেষ্টাকে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন।
এবার গ্রেফতারকৃত বিচারপতির মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা কর্মীদের সংঘর্ষের কারণে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর একদল সদস্যের যোগদানের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগে বাধ্য করানো অবশ্যই নিন্দনীয়। তবে এ জন্য প্রেসিডেন্ট নাশিদও কম দায়ী নন। তিনি বিষয়টিকে নিয়ে আনাড়ির মতো নাড়াচাড়া করেছেন। তার কারণেই এমন প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, তার পছন্দের লোকজনকে দিয়ে তিনি বিচার বিভাগকে পুনর্গঠন করতে চান। এমন পরিস্থিতিতে এবার মালদ্বীপে ভারতীয় হস্তক্ষেপের প্রশ্নই আসেনি।

বি. রমন :চেন্নাইয়ে ট্রপিক্যাল স্টাডিসের পরিচালক আউটলোক থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.