সময়ের প্রেক্ষিত-খালেদ আবদেল নাসেরের যাপিত জীবন by মনজুরুল হক

‘যাও খালেদ, পিতাকে বলে দাও মিসর আজও তাঁকে ভালোবাসে’ অথবা ‘পিতাকে বলে দিয়ো সে চলে যাওয়ার পর অপমান ছাড়া কোনো কিছুই আর আমাদের কপালে জোটেনি’—ওপরে বর্ণিত এই দুটি বাক্য হচ্ছে মিছিলে যোগ দেওয়া মানুষের মুখে উচ্চারিত স্লোগানের অংশ। মিছিলটি ছিল শবযাত্রার মিছিল, মিসরের রাজধানীর রাজপথ অতিক্রম করে যাওয়া যে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ।


যে শবাধার তাদের সামনে ধীরগতিতে চলা গাড়িতে রাখা ছিল, তাতে শায়িত ছিলেন খালেদ আবদেল নাসের, মিসরের প্রয়াত বিপ্লবী নেতা গামাল আবদেল নাসেরের ছেলে, মাত্র ৬২ বছর বয়সে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দীর্ঘ অসুস্থতার পর যিনি মৃত্যুবরণ করেন। শবযাত্রায় যোগদানকারীরা সবাই যে ছিলেন হতদরিদ্র খেটে-খাওয়া মানুষ, তা কিন্তু নয়। ছিলেন সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং দেশের কার্যত রাষ্ট্রপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ হুসেইন তান্তাওই, সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ সামি আনান এবং নাসের অনুসারী রাজনৈতিক দলের নেতারাসহ মিসরের নেতৃত্বস্থানীয় রাজনীতিবিদের প্রায় সবাই। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড, নাসের এবং তাঁর পরিবারকে আজও যারা তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করে থাকে। তবে খালেদ আবদেল নাসেরের জন্য সেটা কোনো উদ্বেগের বিষয় একেবারেই নয়, এ জন্যই নয় যে সব রকম উদ্বেগ আর বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল তাঁর সেই শেষ শোভাযাত্রা। বরং ধর্মভিত্তিক অন্ধ মতাদর্শের অনুসারী একটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে সেটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা।
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় যে আমাদের এই অদ্ভুত সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের ছেলেমেয়েদের দাপটে অস্থির সাধারণ মানুষজন যখন সেসব সন্তানের মৃত্যুতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে থাকে, সে রকম এক সময়ে মিসর ও আরব বিশ্বের একসময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছেলের মৃত্যুতে শোকাহত জনতার বিশাল এক মিছিল যোগ দিয়েছিল তাঁর সেই শেষ শোভাযাত্রায়। আমাদের একালের নেতাদের মনমানসিকতার সঙ্গে গামাল আবদেল নাসেরের মনমানসিকতার ফারাক যে কতটা গভীর, সেই বাস্তবতার খুবই বিশ্বাসযোগ্য ছবি মনে হয় এর মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে।
গামাল আবদেল নাসেরের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ খালেদের জন্ম ১৯৪৯ সালে, বাবা মিসরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার মাত্র বছর তিনেক আগে। গামাল আবদেল নাসের ক্ষমতাসীন ছিলেন ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। ফলে খালেদের বাল্যকাল, কৈশোর আর যৌবনের অনেকটাই কেটেছে ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি অবস্থায় থেকে, অন্যভাবে যেটা হচ্ছে মাথা বিগড়ে যাওয়ার খুব সহজ এক পথ, যে রকমটা আমরা দেখেছি আমাদের ভবনভিত্তিক বিকল্প রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায়। তবে বাবা নাসের মনে হয় সন্তানদের সে রকম কিছু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরেই একেবারে শুরু থেকেই সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন। মিসর এবং মিসরের মানুষকে আন্তরিকভাবে তিনি ভালোবেসেছিলেন বলেই যে রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে ক্ষমতাসীন তিনি হয়েছিলেন, পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে বিকল্প পথে একই সেই রাজতন্ত্রের ধারা তিনি অনুসরণ করতে চাননি। খালেদ আবদেল নাসেরের অবিচুয়ারি বা মৃত্যু-পরবর্তী জীবন বর্ণনায় নিউইয়র্ক টাইমস বাবা নাসেরের চরিত্রের এই বলিষ্ঠ ব্যতিক্রমী দিকটি তুলে ধরে ১৯৬০ সালের এক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে, যেখানে উল্লেখ করা হয় যে বাবার সঙ্গে এক মোটর শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়ার সময় উৎফুল্ল জনতার হর্ষধ্বনির জবাবে খালেদকে হাত নাড়তে দেখে ক্ষুব্ধ প্রেসিডেন্ট নাসের তাঁকে সেদিন ধমকের সুরে বলে উঠেছিলেন পাগল সে হয়ে গেছে কিনা। খালেদ যে হঠাৎ করেই নিজেকে কেউকেটা ভেবে নিতে পারে, সেই চিন্তা প্রেসিডেন্ট নাসেরকে ভাবিত করেছিল। পরে একদিন ছেলেকে ডেকে সরাসরি তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে বাবা বলেছিলেন যে বাবার নাম ভাঙিয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের কোনো রকম তৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার খবর পেলে সরাসরি তিনি তাঁকে সামরিক কারাগারে পাঠিয়ে দেবেন।
পাঠক এবার একবার ভেবে দেখুন, আমাদের প্রথম পরিবারসমূহের পারিবারিক সংস্কৃতি থেকে কতটা দূরত্বে ছিল মিসরের বিপ্লবী নেতার পারিবারিক সংস্কৃতি। শুধু আমাদেরই বলি কেন, এমনকি লিবিয়া এবং খোদ মিসরেই তো দেখা যায় বাবার রাজসিংহাসনে আরোহণ নিশ্চিত করে নিতে ক্ষমতাসীনদের সে কি প্রাণান্তকর প্রয়াস! তবে এতে যে শেষরক্ষা হয় না, গাদ্দাফি আর তদীয় ছেলে সাইফ আল ইসলাম এবং হোসনি মোবারক ও ছেলে গামাল মোবারকের ভাগ্য তো সে কথাই এখন আমাদের বলছে। অন্যদিকে, গামাল আবদেল নাসের সেই পথকে ঘৃণা করেছিলেন বলেই মিসরের জনতা মৃত্যুর পরও তাদের আপনজন ভেবে নিয়ে চোখের জল ফেলছে।
ভাগ্য অবশ্য পরবর্তী সময়ে খালেদ আবদেল নাসেরের প্রতি সদাশয় হয়নি। রাজনীতির অঙ্গনে তিনি কখনোই সেভাবে পদার্পণ করেননি এবং সেই প্রয়োজনও বোধ করেননি। কেননা, পরিবারের পক্ষ থেকে মিসরকে যা দেওয়ার বাবা একাই তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে গেছেন। ফলে লেখাপড়া নিয়েই তিনি বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত ছিলেন এবং পরবর্তী জীবনেও কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পেশা তিনি বেছে নিয়েছিলেন। তবে বাবার মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাতের নেতৃত্বে মিসরের ক্রমশ পশ্চাদপসরণ এবং সেই পথের চূড়ান্ত লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত মার্কিন-ইসরায়েল স্বার্থের কাছে দেশের বিক্রি হয়ে যাওয়াকে তিনি কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ করতে পারেননি। এরও আগে আরও একটি ছোট ঘটনার বর্ণনা নিউইয়র্ক টাইমস দিয়েছে, খালেদ আবদেল নাসেরের চারিত্রিক দৃঢ়তার সুস্পষ্ট আরও প্রমাণ যা কিনা তুলে ধরে।
আনোয়ার সাদাত রাষ্ট্র পরিচালনার হাল ধরার পর একদিন নাসের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে প্রয়াত নেতার বাসভবনে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য যতটা না ছিল পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা, তার চেয়ে বেশি ছিল নাসেরের ব্যবহারের বুলেটপ্রুফ গাড়িটি বাগিয়ে নেওয়া, আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতার বাহক হিসেবে যে গাড়ির প্রতীকী একটি গুরুত্ব তখনো ছিল। নাসেরের বাসভবনে তাঁর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াবলির একটি স্মৃতি হিসেবে গাড়িটি সংরক্ষণ করা ছিল। আনোয়ার সাদাতের অনুরোধ খালেদ সেদিন সরাসরি এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে গাড়িটি রাষ্ট্রের নয়, বরং ব্যক্তি নাসেরের। এর পরও যখন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে গাড়ি ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ আসতে থাকে, তখন একদিন পেট্রল ঢেলে সেই গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে সান্ত্বনা পেয়েছিলেন খালেদ এবং আনোয়ার সাদাতকে বাবার সেই গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ থেকে করেছিলেন বঞ্চিত।
মিসরের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়াকে আরব বিশ্বের বিবেকবান যেকোনো ব্যক্তির মতো খালেদও মেনে নিতে পারেননি। সে রকম এক সময়ে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটানো বাবার এক ঘনিষ্ঠ অনুসারী মাহমুদ নুরেদ্দিনের সঙ্গে মিলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবী মিসর নামের গুপ্ত এক সমিতি, কায়রোতে সমবেত হতে থাকা ইসরায়েলি কূটনীতিকদের ওপর হামলা চালিয়ে শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করার পথ যে সমিতি বেছে নিয়েছিল। ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে গুপ্ত সেই সমিতি ইসরায়েলি কূটনীতিকদের ওপর তিনটি হামলা চালিয়ে দুজনকে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য মিসরের গোয়েন্দা পুলিশ হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। বিচার-প্রক্রিয়ায় খালেদকেও আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে গোপনে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে শুরুতে লন্ডনে এবং পরে সেখান থেকে বেলগ্রেডে গিয়ে আশ্রয় নেন। খালেদের অনুপস্থিতিতে চলা বিচারে আদালত তাঁকে এবং নুরেদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। পরে অবশ্য আরব নেতাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক মামলার পুনর্বিচারে সম্মত হন এবং বিচারের মুখোমুখি হতে খালেদ এরপর ১৯৯১ সালে দেশে ফিরে আসেন। দ্বিতীয় সেই বিচারের রায়ে তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয় এবং কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় তিনি ফিরে যান।
এর পর থেকে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র অনেকটাই ছিল পরোক্ষ। তবে হোসনি মোবারকের দীর্ঘ অপশাসনে নাসেরের ভাবমূর্তি ক্রমশ আবারও ফিরে আসতে শুরু করলে রাজনীতির সহযোদ্ধারা বরাবরই পরামর্শের জন্য সব সময় খালেদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর শেষ রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল, মোবারকবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে তাহরির স্কয়ারে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের উৎসাহ দেওয়া। অসুস্থ শরীর নিয়েই সেখানে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন এবং মিসরের তরুণ প্রজন্ম যে গামাল আবদেল নাসেরের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের দৃষ্টান্তে আবারও উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করেছে, তা দেখতে পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলেন তিনি।
মিসরের ইতিহাসে নতুন এক যুগের সূচনালগ্নে চলে গেলেন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক বাবার আপসহীন এক সন্তান। এরাই তো যুগ যুগ ধরে দেশে দেশে বাঁচিয়ে রাখে রাজনীতির সেই আদর্শকে, যে আদর্শের জলাঞ্জলি হওয়া প্রতিনিয়ত আমরা লক্ষ করি মিসরে, পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে এবং এমনকি রক্ত আর অশ্রুতে ভিজে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীন স্বদেশভূমিতে।
(টোকিও, ৪ অক্টোবর ২০১১)
 মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.