মাতৃময়ী দুর্গার আবাহন জগতে শান্তি আনুক-শুভ বিজয়া

বিজয়া দশমী আজ। শারদীয় দুর্গোৎসবের আজ শেষ দিন। দুর্গার বিদায়লগ্নের আনন্দ-বেদনা মেশানো অনুভূতি আজ ভক্তদের মনকে সিক্ত করে আছে। বাঙালি হিন্দু সমাজের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের এই শুভ ক্ষণে আমরা সবাইকে জানাই শারদীয় শুভেচ্ছা।
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে দুর্গাদেবী পরম ভক্তি পেয়ে থাকেন। তাঁর এক রূপ অসুরবিনাশী, আরেক রূপ মাতৃময়ী ভালোবাসার। শক্তি ও মমতার এই দুই শক্তির গুণেই তিনি দেবকুলের কাছে পরম পূজনীয় হিসেবে গণ্য হন। পৌরাণিক আখ্যান অনুযায়ী, তিনি অশুভর প্রতীক অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। তাঁর এই জয়ের মধ্য দিয়ে অন্যায়-অশুভর বিপরীতে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। সেই থেকে হিন্দু সমাজের উচ্চ অংশে তিনি কেবল সৌন্দর্য-মমতা-সৃজনের আধার হিসেবেই বিবেচিত হন না, তিনি অসহায় ও নিপীড়িতের আশ্রয় বলেও গণ্য হন। মানবকুলের জন্য তিনি বহন করে আনেন মঙ্গলবার্তা। যেকোনো ধর্মের পরম প্রতীকের গুরুত্ব এখানেই যে তা সব মানুষের মধ্যেই শুভবোধের সঞ্চার ঘটাতে সক্ষম। এটাই ধর্মীয় প্রতীকের সর্বজনীন তাৎপর্য।
শারদীয় দুর্গাপূজা কেবল আরাধনার উপলক্ষই নয়, তা হিন্দু সমাজকে উৎসবের আনন্দ-মিলনের সুযোগও। এবং সেই আনন্দ ধর্মসম্প্রদায়ের গণ্ডি ছাপিয়ে সমাজের সবাইকে আবাহন করে, কাছে ডেকে নেয়। দুর্গোৎসব তাই দিনে দিনে হয়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম বৃহৎ সামাজিক উৎসব। কেবল বাংলাদেশ বা ভারতেরই নয়, সারা দুনিয়ার বাঙালি হিন্দুরা এই উৎসবকে তাঁদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের মধ্যমণি হিসেবে দেখে থাকেন।
আদিতে কেবল বনেদি জমিদারবাড়ির উৎসব হয়ে থাকলেও কালক্রমে দুর্গোৎসবের আকর্ষণ বর্ণনির্বিশেষে হিন্দু সমাজের সব অংশেই ছড়িয়ে গেছে। এই উৎসবে হিন্দু-মুসলিম প্রতিবেশী ও বন্ধুদের মধ্যে শুভেচ্ছা ও সম্প্রীতির আদান-প্রদানও অনেক বেশি করে ঘটে। এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে বাঙালি সংস্কৃতির ভেতরকার সর্বপ্রাণবাদ, নারী তথা মাতৃ চরিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এই গুণাবলি যতটা ধর্মের বিশ্বাস, ততটাই সংস্কৃতির প্রাণরসও।
এ বছর সারা দেশে সপ্রাণতা ও উদ্দীপনার মাধ্যমে সম্প্রীতির পরিবেশে দুর্গোৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে। সবচেয়ে শান্তির কথা যে পূজা উপলক্ষে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি; ঘটতে পারেনি। সরকার-প্রশাসনের আন্তরিক সদিচ্ছায় যে এ ধরনের শান্তিপূর্ণ, ভীতিশঙ্কামুক্ত, সৌহার্দ্যময় পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব, তা আবারও লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব মন্দির প্রাঙ্গণের উৎসবমুখরতায় তা-ই দেখা যাচ্ছে। নারী-শিশুসহ সব বয়সের, সব ধর্মের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ-উল্লাস সামাজিক শান্তির আভাস দেয়। প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব এভাবে শান্তি ও সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে উদ্যাপিত হবে—সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মানুষে-মানুষে সব বিভেদ ও সংকীর্ণতা চিরতরে দূর হয়ে যাক; মিলন ও সম্প্রীতির ধারা শক্তিশালী হোক। বিজয়া দশমীতে আমাদের কামনা সত্য, ন্যায় ও শুভশক্তির বিজয়।

No comments

Powered by Blogger.