চরাচর-হারিয়ে যাচ্ছে লাটিম খেলা by বিশ্বজিৎ পাল বাবু

লাটিম বা লাট্টু খেলা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক একটি খেলা। একসময় শহরাঞ্চলেও তা ব্যাপকভাবে চালু ছিল। কাবাডি, মোরগ লড়াই, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা, কানামাছির মতো লাটিম খেলাটিও আজ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। আগের মতো এখন আর কাউকে লাটিম খেলতে দেখা যায় না।


নানা ঋতুভিত্তিক মেলায়ও খেলনা-পসরায় লাটিম তেমন দেখা যায় না। গ্রামের ছোট দোকানঘরের কাচের বয়ামে এখন আর লাটিম সাজিয়ে রাখতেও দেখা যায় না। মূলত কাঠ দিয়ে গোল করে বানানো হয় লাটিম। গোলাকার এ বস্তুটির ওপর সুতা বা 'লেত্তি' আটকানোর জন্য খাঁজ কাটা থাকে। নিচের অংশে থাকে লোহা আটকানো। আগে কাঠমিস্ত্রিরা লাটিম বানাতেন। সাধারণত পেয়ারা ও গাবগাছের কাঠ দিয়েই লাটিম বানানো হতো। নির্বাচিত পাট থেকে লাটিমের জন্য ফিতা বা লতি বা লেত্তি বানানো হতো। এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তুলাজাতীয় নরম কাঠ দিয়ে লাটিম বানানো হয়। গেঞ্জির কাপড় দিয়ে বানানো হয় ফিতা। লাটিম লাল, নীল, বেগুনি ইত্যাদি বাহারি রঙের হয়ে থাকে। লাটিম খেলা সাধারণত দুই রকমের। বেল্লাপার ও ঘরকোপ। দুটি পৃথক নিয়মে হয়ে থাকে এর প্রতিযোগিতা। বেল্লপারে একটি দাগ কেটে সীমানা চিহ্নিত করা হয়। ঘূর্ণিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্ধারণী খেলায় যে পরাজিত হয় তার লাটিমকে অন্য প্রতিযোগীরা নিজেদের লাটিম দিয়ে আঘাত করে দাগের বাইরে বের করে দেয়। ঘূর্ণায়মান লাটিম হাতে নিয়েও প্রতিযোগী লাটিমকে আঘাত করা যায়। মাটিতে রাখা লাটিমকে আঘাত করতে ব্যর্থ হলে আবার ওই ব্যর্থ লাটিমকে রাখা হয়। একইভাবে ওই লাটিমে আঘাত করে বেল্লাপার করা হয়। শর্ত অনুসারে সীমানা পার করা লাটিমকে নিজের লাটিম কিংবা দা দিয়েও কোপ দেওয়া যায়। ঘরকোপ খেলতে প্রথমে একটি বৃত্ত আঁকা হয়। নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে বৃত্তের ভেতরে লাটিম ফেলে রাখা হয়। অন্য প্রতিযোগীরা বৃত্তের ভেতরের লাটিমকে নিজের লাটিম দিয়ে আঘাত করাই হচ্ছে এ খেলার উদ্দেশ্য। একসময় গ্রামের আনাচে-কানাচে এমনকি শহরজীবনেও চোখে পড়ত নান্দনিক এ লাটিম খেলা। গ্রামের দোকানগুলোয় সিগারেটের বাক্সের পাশেই রাখা কাচের বয়ামে শোভা পেত নানা রঙের লাটিম। কিন্তু ক্রিকেট ও ফুটবলের জনপ্রিয়তার চাপে এখন অন্য গ্রামীণ খেলাধুলার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে লাটিম খেলাও। লাটিম, এক্কা দোক্কা, গোল্লাছুট_এ রকম সব নির্দোষ নান্দনিক খেলা আমাদের, বিশেষ করে শৈশবের, জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকায় সমাজে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অবক্ষয় ও অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলেছে। অথচ এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ধরে রাখতে আমাদের আধুনিক সমাজের অভিভাবকদের এবং সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
বিশ্বজিৎ পাল বাবু

No comments

Powered by Blogger.