রেলইঞ্জিন থেকে তেল চুরি-নেতৃত্বে বহিষ্কৃত নেতা, বড় চক্র জড়িত by এম আর আলম

১ জানুয়ারি রাত ১০টা। ঘটনাস্থল, দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেলওয়ে লোকোশেড। শেডের পূর্ব দিকঘেঁষা রেললাইনে দাঁড়িয়ে আছে একটি ইঞ্জিনবগি। বগি থেকে এক লোককে নামতে দেখা গেল। হাতে থাকা টর্চটি বার কয়েক জ্বলল। খানিক দূরে আরেকটি টর্চের আলো জ্বলতে-নিভতে দেখা গেল। সংকেত আদান-প্রদান শেষে কাছাকাছি এল দুজন। একজনের হাতে জারিকেন ও একটি পাইপ। একজন রেলইঞ্জিনের তেলের ট্যাংকে পাইপের এক মাথা ধরল।


অপরজন পাইপের অন্য মাথাটি ঢুকিয়ে দিল জারিকেনের ভেতর। এরপর জারিকেনভর্তি তেল নিয়ে সটকে পড়ল একজন। এভাবে প্রায় প্রতি রাতেই পার্বতীপুর রেল লোকোশেড থেকে ডিজেল চুরি হয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে।
অভিযোগ আছে, সংঘবদ্ধ একটি চক্র পার্বতীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত ত্রাণ সম্পাদক ফয়সাল আলম ওরফে বিজ্ঞানের ছত্রচ্ছায়ায় তেল চুরি করছে। তবে ফয়সাল জানান, তিনি এ ঘটনায় জড়িত নন।
উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শফিকুর রায়হান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ফয়সাল তেল চুরির প্রধান হোতা। তাঁর নেতৃত্বেই এ কাজ হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম বলেন, ‘শুনেছি, ফয়সাল রেলের তেল চুরির ঘটনায় জড়িত।’
ফয়সাল আলম উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ সম্পাদক ছিলেন। তার আগে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। পৌর নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পার্বতীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শওকত আলী জানান, তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি ও সড়ক ডাকাতির মামলা রয়েছে।
লোকোশেড হচ্ছে রেলইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ স্থাপনা। এখান থেকে প্রায় প্রতি রাতেই রেলের ডিজেল চুরির ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় লোকজন ও রেলওয়ের কিছু কর্মচারীর কাছ থেকে এ অভিযোগ পেয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মাসব্যাপী অনুসন্ধান চালানো হয়। অনুসন্ধানে এ অভিযোগের সত্যতা মেলে এবং কৌশলে ছবিও তোলা সম্ভব হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লোকোশেডের এক কর্মচারী বলেন, ‘রেলইঞ্জিনের চালকেরা (লোকোমাস্টার) ৩৫ টাকা লিটার দরে ডিজেল বেচে দেন। শেডের উপসহকারী প্রকৌশলীরা (এসএই) সেই ডিজেল কেনেন। এসএইরা সেই তেল ১০ টাকা লাভে বিক্রি করেন সংঘবদ্ধ একটি চক্রের কাছে।’
লোকোশেডে তেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ডিজেল চুরি হওয়ার কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন। তবে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত বলতে রাজি হননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চক্রটি স্থানীয় দোকানিদের কাছে এই ডিজেল বিক্রি করে। সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে ছয়-সাত টাকা কমে সেই ডিজেল কেনেন দোকানিরা। পরে তাঁরা খুচরা ক্রেতাদের কাছে ৬২ টাকা লিটার দরে বিক্রি করেন। সংঘবদ্ধ চক্রের কাছ থেকে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা লিটারপ্রতি ছয় টাকা ভাগ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পার্বতীপুর লোকোশেডের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, লোকোশেডে আসার পর রেলইঞ্জিনে পাম্পের সাহায্যে ফুয়েল ট্যাংকারে ডিজেল ঢোকানো হয়। সেই তেল বের করা হয় না।
ছদ্মবেশেও হয় চুরি: লোকোশেডের উত্তর পাশে নতুন বাজার মোড়ে গত ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টার দিকে তেল চুরির আরেকটি দৃশ্য প্রথম আলোর সাংবাদিকদের চোখে পড়ে। নতুন বছর ২০১২-কে বরণ করতে তখন হই-হল্লোড় চলছিল। কুয়াশার চাদরে ঢাকা গোটা প্রান্তর। অল্প দূরের বস্তুও চোখে পড়ে না। এমন পরিবেশে ১০-১২ জন বোরকা পরা নারী হাঁড়ি-পাতিল হাতে ঢুকে পড়ে লোকোশেডে। এক ঘণ্টা ধরে চলে তাদের আনাগোনা। খানিকটা কাছে যেতেই বোঝা গেল, বোরকা পরিহিতরা নারী নয়; এরা পুরুষ, রেলইঞ্জিন থেকে ডিজেল চুরি করছে।
পার্বতীপুর জিআরপি (রেলওয়ে পুলিশ) থানার ২০০ মিটার উত্তরে লোকোশেড-সংলগ্ন পানির ট্যাংক এলাকা। এখানে রেলইঞ্জিন দাঁড় করিয়ে পাইপের মাধ্যমে ড্রাম, হাঁড়ি-পাতিল ও জারিকেনে করে ডিজেল নামানো হয়। এই তেল প্রথমে রেলস্টেশন-সংলগ্ন চাটাইঘেরা একটি ঘরে মজুদ করা হয়। ঘরটি জিআরপি থানার সামনে ৫০ মিটার দূরে অবস্থিত। তারপর এখান থেকে তেল যায় বিলাইচণ্ডী, ডোমার, দারোয়ানী, ভবানীপুর রেলস্টেশন এলাকাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে।
যেখানে মেলে: পার্বতীপুরের রামপুরা বাজারের খুচরা তেল বিক্রেতা বাবুল হোসেন। লোকোশেড থেকে আসা ডিজেল কম দামে কেনেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, ‘পার্বতীপুরের প্রায় সব খুচরা দোকানেই পাওয়া যায় লোকোশেডের তেল। আমরা কিনলে দোষ কী?’ কত দামে ডিজেল কেনেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাম্পের তুলনায় ছয়-সাত টাকা কমে। ওই টাকাটা আমাদের লাভ।’ লোকোশেডের ডিজেলের গুণগত মান ভালো বলে মন্তব্য করেন বাবুল হোসেন। তিনি জানান, পার্বতীপুরের বিলাইচণ্ডী, জয়চণ্ডী, বেনিরহাট, জশাইহাট, বিন্যাকুড়ি, কারেন্টের হাট, ক্যাম্পের হাট, সোনাপুকুর বাজার, চম্পাতলী ও সৈয়দপুরের চৌমহনী, লক্ষ্মণপুর, মুচিরহাট—এসব জায়গায় লোকোশেডের তেল পাওয়া যায়।
এসব দোকান অবৈধ উল্লেখ করে পার্বতীপুর রেলওয়ে তেল ডিপোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শওকত আলী বলেন, পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ বিক্রি ও বিপণনকারীর অবশ্যই বিস্ফোরক লাইসেন্স থাকতে হবে। সাধারণত পাম্প বা ফিলিংস্টেশন ছাড়া এ-জাতীয় লাইসেন্স দেওয়া হয় না।
আরও যারা জড়িত: পার্বতীপুরের নতুন বাজার মহল্লার মজিবর রহমান, লিটন ও কালীবাড়ির কুসুম ওই চক্রের হয়ে কাজ করে বলে স্বীকার করেছে। এরা বোরকা পরা ছদ্মবেশী দলের সদস্য।
শেডের তেল চুরির সঙ্গে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও রেলওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু শেড থেকে নয়, বেশ কিছু আউটার সিগন্যালেও ইঞ্জিন থামিয়ে তেল চুরি করা হয়। এসব আউটার সিগন্যালের অবস্থান সৈয়দপুর-পার্বতীপুর রেলপথের বিলাইচণ্ডী স্টেশন, সৈয়দপুর-চিলাহাটি সেকশনে দারোয়ানী স্টেশন, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট সেকশনে খোলাহাটি স্টেশন এলাকায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য: পার্বতীপুর লোকোশেডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কমলকৃষ্ণ গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।’ তিনি এ-সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।
পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী দুলাল কুমার রায় ও বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (লালমনিরহাট) তাপস কুমার দাসের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে দুজনই রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সমালোচনা করেন। তবে তেল চুরির ব্যাপারে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পার্বতীপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুজিব-উল ফেরদৌস জানান, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। চুরি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর মুখ্য পরিদর্শক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুরি বন্ধের দায়িত্ব আমাদের না। লোকোশেডে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেই তেল চুরি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।’ পার্বতীপুর জিআরপি থানার ওসি এমদাদুল হকের সঙ্গে কথা বললে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান।
রেলের তেল চুরির ব্যাপারে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপককে চিঠি দিয়েছেন পার্বতীপুর যুবলীগের সভাপতি শফিকুর রায়হান। নিজেকে সচেতন নাগরিক দাবি করে তিনি বলেন, ‘তেল চুরি বন্ধে রেল প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। নতুন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে লিখিতভাবে জানাব।’
চুরি যাওয়া তেলের পরিমাণ: লোকোশেডের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ১৫ লাখ লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি ডিপো আছে এখানে। তাতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে সাত লাখ লিটার ডিজেল মজুদ থাকে। রেলইঞ্জিন ও অন্যান্য খাতে প্রতিদিন গড়ে ১৬ হাজার ৮৬০ লিটার ডিজেল সরবরাহ করা হয়।
পার্বতীপুর-ঢাকা রেলপথে (৭৮২ কিলোমিটার) আন্তনগর নীলসাগর এক্সপ্রেসের যাতায়াতের জন্য এক হাজার ৮৭৫ লিটার, একই পথে যাতায়াতের জন্য একতা এক্সপ্রেসে এক হাজার ৫০৫ লিটার ডিজেল নেওয়া হয়। এভাবে প্রতিদিন ১৭-১৮টি রেলইঞ্জিনে জ্বালানি ভরা হয় লোকোশেড থেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের একাধিক চালক জানান, প্রতিদিন যাতায়াত শেষে একটি ইঞ্জিনে ৫০-১০০ লিটার ডিজেল উদ্বৃত্ত থাকে। সে হিসাবে সব কটি ইঞ্জিন থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ লিটার ডিজেল সাশ্রয় হয়। এ ছাড়া হালকা মেরামত, ইয়ার্ড সান্টিংয়ের (ইঞ্জিন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরানো) নাম করে আরও ২০০ লিটার তেল সাশ্রয় করা হয়। সব মিলিয়ে প্রতিদিন এক হাজার লিটার তেল নানাভাবে বাঁচানো হয়। পরে তা চুরি করে বেচে দেওয়া হয়। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক হাজার লিটার ডিজেলের বাজারদর ছিল ৫৭ হাজার টাকা। সে হিসাবে ৩৬৫ দিন বা এক বছরে লোকোশেড থেকে আনুমানিক দুই কোটি আট লাখ পাঁচ হাজার টাকার ডিজেল চুরি গেছে।
লোকোশেডের এক কর্মকর্তা জানান, সৈয়দপুর রেলওয়ে বিভাগের অধীনে পার্বতীপুর শেড থেকে প্রতি রাতে ১০-১১ ড্রাম তেল চুরি হচ্ছে। প্রতি ড্রামে ১০০ লিটার ডিজেল ধরে।

No comments

Powered by Blogger.