স্মরণ-সেলিম আল দীনের সমাধি প্রাঙ্গণে

‘স্যার, আমি আমাদের স্বপ্নদলের আগামী প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর-এর ভাষায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে চাই, বিশেষ করে ‘করলুম’, ‘খেলুম’, ‘গেলুম’-এর স্থলে ‘করলাম’, ‘খেলাম’, ‘গেলাম’ প্রভৃতি ব্যবহার করতে চাই।’ ২০০৬ সালের শেষের দিকে একদিন তখন বেশ রাত, তিনি ফেনীতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে—মোবাইল ফোনে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন। খানিক পরে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন করতে চাও বলো তো?’ উত্তরে বললাম, ‘নাট্যের উদ্দেশ্য
যদি হয় দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, তাহলে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এ শব্দগুলো তা ব্যাহত করছে অন্তত বর্তমান দর্শককে। কারণ, আমরা এভাবে কথা বলি না।’ তিনি আরও কিছু যুক্তি উত্থাপন করতে বললেন এবং সিদ্ধান্ত জানালেন, ‘হ্যাঁ, করে ফেলো। স্পর্ধা মনে হতে পারে কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তবে যদি কখনো কলকাতায় প্রদর্শনী করো, তখন ওই শব্দগুলো রেখো। কারণ ওরা এগুলো আঞ্চলিকভাবে ব্যবহার করে।’
শিল্পের যেকোনো দুরূহ প্রশ্নের মীমাংসায় কিংবা যেকোনো দ্বিধাক্ষণে এভাবে যেমন তাঁর শরণাপন্ন হতাম আমরা, আর কী অবলীলায় তিনি সেলিম আল দীন, সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমণের পথনির্দেশ করতেন আমাদের! তাই শিল্প-সংসারের নানা কর্মে-সংযোগেই তো তাঁর শিল্পপুত্র এই আমার, আমাদের অন্তরে সদা সমাসীন তিনি। সর্বশেষ অসম্পূর্ণ রচনা হাড়হাড্ডি প্রসঙ্গে একদিন আমার যে অনুভূতি হয়েছিল, তা আবারও আজ এই মুহূর্তে হূদয়ে উচ্চকিত হলো, ‘মাতা এবং গুরু তো চির-অমর!’ তাঁর সঙ্গে হাজারো স্মৃতিঠাসা সুধাপাত্র খুলে গিয়ে নানা প্রসঙ্গের পাশাপাশি এই কথাগুলো মনে ভাসছিল বাসে চলমান আমার। ২২ ডিসেম্বর ২০১১। আমরা ‘স্বপ্নদল’ চলেছি ফরিদপুর বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী আয়োজিত রবীন্দ্র নাট্যোৎসব-২০১১-এ দলের সাম্প্রতিক প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা মঞ্চায়নে। সকাল সাতটায় রওনা হয়েছি নির্ধারিত বাসসহযোগে শিল্পকলা একাডেমী থেকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখপথ অতিক্রম করব আর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নাট্যগুরুর সমাধির পাশে দুদণ্ড দল নিয়ে দাঁড়াব না, তা কী হয়! আপাতত আমাদের গন্তব্য তাই নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের সমাধি প্রাঙ্গণ!
চিত্রাঙ্গদা প্রসঙ্গটি ভাবতেই আবার মনে পড়ল, ছাত্রাবস্থায় তিনি কীভাবে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এ নাটকটি পঠন ও অনুধাবনে। তিনি বলতেন, চিত্রাঙ্গদায় যেভাবে নারী-অধিকারের প্রসঙ্গটি এসেছে, তা সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথ এ রচনায় সমকালীন কবির দায়িত্ব পালনে তাই মহাভারতকেই যেন সংশোধন করেছেন। অল্পবয়সের অস্থিরতায় তখন একে অতিকথন মনে হলেও আজ বুঝি কথাটির সত্যতা কোন মাত্রার এবং তা আমার অন্তরে কী অমোচনীয় ছাপ-ই না রেখেছিল। কেন জানি বিশ্বাস হয়, আমাদের পূর্ববর্তী প্রযোজনা হরগজ-এ যেমন সেলিম আল দীন সর্বক্ষণ পাশে ছিলেন, এই কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা নির্মাণেও তিনি ছিলেন আমাদের সদাসঙ্গী। এমনকি এখনো, এই মুহূর্তে তিনি চলেছেন আমাদের সঙ্গে! যুক্তি জানি না, শুধু অন্তরে অনুভব, আত্মা যদি অবিনশ্বর হয়, তবে এ শিষ্যের অভিযাত্রায় নাট্যগুরুও কি আমাদের সহযাত্রী হবেন না?
এভাবে নানা ভাবনার সুখ-পরশে নানা অনুভূতির বুননে পৌঁছে গেছি জাহাঙ্গীরনগর। ভাবছি, ইংল্যান্ডে যেমন ওয়ারউইকশায়ারের হলি ট্রিনিটি চার্চে শেক্সপীয়রের সমাধি সমগ্র বিশ্বের শিল্পানুরাগীদের দর্শনীয় পুণ্যস্থান, বাঙালির সহস্র বছরের নাট্য-ঐতিহ্যের বারতা স্কন্ধে বহনকারী ও আধুনিক শিল্পানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণকারী সেলিম আল দীনের সমাধি আর শিল্প-সতেজ ভূমি জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ও কি একদিন অনুরূপ মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে উঠবে না? নাটক ও নাট্যতত্ত্বের একজন সামান্য শিক্ষার্থী হিসেবে তো এটুকু দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি যে, আপন ঐতিহ্যের ধারায় আধুনিক নাট্যনির্মাণে ও আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অন্তত সমগ্র বিশ্বে সেলিম আল দীনের সমকক্ষ আর কেউ আছেন কি না সন্দেহ!
কিন্তু সেলিম আল দীনের সমাধি প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সমস্ত শরীরই যেন কেঁপে উঠল! মূল সড়ক থেকে সমাধি পর্যন্ত পথের ঘাস অযত্নে বড় হয়ে আছে। হয়তো-বা নিয়মিত যাতায়াত নেই বলে! আরও একটু এগোতেই দেখি, সমাধির মাটি ধসে পড়েছে। অকৃতজ্ঞতার উৎকৃষ্ট নিদর্শনরূপে নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে সমাধিটি! যাঁরা সেলিম আল দীনের জন্মদিন অথবা প্রয়াণ দিবসে এখানে শ্রদ্ধা নিবেদনে আসেন আর সাজানো পুষ্পাচ্ছাদিত অস্থায়ী সমাধিসৌধ প্রত্যক্ষ করে তৃপ্তি নিয়ে ফেরেন স্বকর্মে, তাঁরা কল্পনাও করতে পারবেন না এ নিদারুণ অবহেলা। সমাধির ওপরে ঘাসের আচ্ছাদন নেই, নেই দৃষ্টিনন্দন প্রত্যাশিত সবুজ। হায়! তিনি এ দেশে, এ শিল্প-ভূগোলে কম তো সবুজ ফলাননি আর তাঁর সমাধিতেই শ্যামলের কমতি পড়ল? কী দুর্ভাগা আমরা!
সেলিম আল দীন জন্মগ্রহণ না করলে আজ আমাদের উপনিবেশ-উত্তর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিশেষ করে নাট্য-উপস্থাপনা কোন বিজাতীয় কৃত্যের সেবাদাস হয়ে দিনাতিপাত করত, তা সচেতন শিক্ষিতমাত্রেই অবগত। তাঁর কল্যাণেই আজ আমাদের অনেকের নির্দেশক-অভিনেতা-নির্মাতা-শিক্ষক-সংগঠক-তাত্ত্বিক-প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নাট্যশিক্ষায় শিক্ষিত কিংবা রুটি-রুজির প্রতিযোগিতায় সফল বলে পরিচয়—আমরা এ ভয়াবহ দায় এড়াব কী করে? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই বা কী বলবেন? যা-ই হোক, আমাদের অকৃতজ্ঞতার পরিসীমা আরও দীর্ঘ না করে কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্তে যত শিগগির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, ততই মঙ্গল।
চতুর্থ প্রয়াণবার্ষিকীর এই দিনে সেলিম আল দীনের পুণ্যস্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
জাহিদ রিপন

No comments

Powered by Blogger.