শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন-লেখাপড়ায় আনন্দযোগ by শংকর দাস ও মিজানুর রহমান

‘স্কুলে আসতে খুব ভালো লাগে। এখানে এসে স্লাইডে উঠি, দোলনায় দুলি, খেলাধুলা করি। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এসব করতে খুব মজা হয়। ছুটির পরও বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে না।’ বলছিল পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার উত্তর-পশ্চিম মদনপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী ঊর্মি আক্তার। ঊর্মির এই অনুভূতি যেন বাউফলের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের অনুভূতির প্রতিধ্বনি।


এই উপজেলার ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী প্রায় শতভাগ শিশুই বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতির হার বেড়েছে, কমেছে ঝরে পড়ার হার। ২০১০ ও ২০১১ সালে পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় এ উপজেলার শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
বিদ্যালয়ে শিশুদের পড়াশোনা আনন্দময় করে তুলতে নেওয়া উদ্যোগের ফলেই এ কৃতিত্ব অর্জন সম্ভব হয়েছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাউফলের ২২৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১১৪টিতে ‘মিনি শিশুপার্ক’ করা হয়েছে। অন্যগুলোতেও মিনি শিশুপার্ক তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া ৬৫টি বিদ্যালয়ের সংযোগ সড়ক পাকা করা হয়েছে। সংস্কার করা হয়েছে বিদ্যালয়ের মাঠ, পুকুর, ডোবা ও পতিত জমি। পুকুরে মাছ ও পতিত জমিতে সবজি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দরিদ্র শিশুদের সহায়তায় এই আয় ব্যবহার করা হবে।
যেভাবে শুরু: জাতীয় সংসদের হুইপ ও স্থানীয় সাংসদ আ স ম ফিরোজ এবং বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানের উদ্যোগে ২০১০ সালে বিদ্যালয়গুলোতে মিনি শিশুপার্ক তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। হুইপের বিশেষ বরাদ্দ ও উপজেলার অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্প, ৬০ দিনের বিশেষ প্রকল্প, কাবিখা, কাবিটাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এ কার্যক্রম শুরু হয়, যা ২০১২ সালে শেষ হওয়ার কথা। বাউফল উপজেলা পরিষদ এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
প্রতিটি মিনি শিশুপার্ক স্থাপনে ব্যয় হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এসব শিশুপার্কে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ঢেঁকি দোলনা, দোলনা ও স্লাইড তৈরি করা হয়েছে।
সরেজমিন: সম্প্রতি উপজেলার মধ্য জৌতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে শিশুরা খেলছে। কেউ দোলনায় দুলছে, কেউ স্লাইডে উঠছে-নামছে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে খেলাধুলা করতে পেরে সবাই বেশ খুশি।
উত্তর-পশ্চিম মদনপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই চিত্র দেখা গেল। তবে ক্লাসের ঘণ্টা বেজে উঠলে সবাই শ্রেণীকক্ষে চলে যায়।
এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতিকুর রহমান জানান, বিদ্যালয়ের মাঠে তৈরি করা ‘মিনি শিশুপার্ক’ শিশুদের বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া ২০১০ সালে বিদ্যালয়ের সামনের সড়ক পাকা হয়েছে। আগে ধুলা-কাদার কারণে শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে ভোগান্তিতে পড়ত।
মদনপুরা বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে কথা হলো প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিমের সঙ্গে। মিনি শিশুপার্ক তৈরির ফলে শিশুদের উপস্থিতির হার বেড়েছে। আগে ৮৫ থেকে ৮৮ ভাগ উপস্থিতি থাকলেও এখন এ হার প্রায় শতভাগ বলে জানান তিনি। বিদ্যালয়ে শিশু অবিনাশকে নিয়ে এসেছেন মা অঞ্জনা রানী। অঞ্জনা জানান, মিনি শিশুপার্ক করার পর তাঁর ছেলের বিদ্যালয়ে আসার আগ্রহ বেড়েছে।
‘এখন শিশুদের উপস্থিতি বেড়েছে। কচিমুখে ভরা শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের পড়ানোর আগ্রহও বেড়েছে।’ বলছিলেন বিলবিলাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শারমিন খানম।
বাউফল আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আছমা পারভিন জানান, পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় এ বিদ্যালয় থেকে ৫৯ জন অংশ নিয়ে সবাই পাস করেছে। এত ভালো ফলে মিনি শিশুপার্কের অবদান রয়েছে।
কাছিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব কালাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাজিরপুর বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের তথ্য মিলেছে। নাজিরপুর বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র রফিকুল ইসলাম বলে, ‘আগে স্কুলে আসতে ভালো লাগত না। খেলতে পারতাম না, বর্ষাকালে স্কুলের মাঠ ডুবে থাকত। এখন খেলাধুলার অনেক কিছু হয়েছে। তাই প্রতিদিন বিদ্যালয়ে আসি। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে খেলি।’
মিনি শিশুপার্ক স্থাপন করা হয়েছে, এমন কয়েকটি স্কুল ঘুরে দেখা যায়, সব শ্রেণীকক্ষের নামকরণ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা এসব নামের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। একই সঙ্গে দেওয়া হয়েছে এসব ব্যক্তির ছবিও। স্কুলগুলোর বিভিন্ন কক্ষের নাম রাখা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি সুফিয়া কামাল এবং সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর নামে। কোমলমতি শিশুরা যাতে সুন্দরভাবে খেলাধুলা করতে পারে, সে জন্য এসব স্কুলের মাঠগুলোরও উন্নয়ন করা হয়েছে।
উপজেলা শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য: উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ২২৫টি বিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে ভর্তির হার ছিল ৯৩ শতাংশ। সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৯৭ শতাংশ। আর ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
মিনি শিশুপার্ক ও বিদ্যালয়ের সংযোগ সড়ক পাকা করায় শিশু ভর্তি ও পাসের হার প্রায় শতভাগ ছুঁয়েছে। ঝরে পড়ার হার ৯ দশমিক ৬২ শতাংশে নেমে এসেছে।
তাঁরা যা বলেন: বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান জানান, মিনি শিশুপার্ক ছাড়াও ৮৮টি বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ও ৩৬টি বিদ্যালয়ের মজা পুকুর সংস্কার করা হয়েছে। পুকুরগুলোতে মাছ চাষের জন্য এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়গুলোর পরিত্যক্ত জমিতে মৌসুমি সবজি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ মাছ ও সবজির আয়ে দরিদ্র শিশুদের সহায়তা করা হবে। তিনি আরও জানান, উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে ৪৭২ পৃষ্ঠার ‘তথ্যকণিকা’ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে সব বিদ্যালয়ের বিভিন্ন তথ্য রয়েছে।
এসব উদ্যোগ নেওয়ায় চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ২০১০ সালে জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক’-এর পুরস্কার পেয়েছেন।
‘শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা আনন্দময় করে তুলতেই এ উদ্যোগ।’ বলছিলেন হুইপ আ স ম ফিরোজ। তাঁর মতে, এ ধরনের ব্যবস্থা লেখাপড়াকে খুদে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে। দেশের অন্যান্য এলাকার গ্রামীণ স্কুলগুলোতে এর বিস্তার ঘটানো দরকার।

No comments

Powered by Blogger.