দাহকালের কথা-‘যখন আশ্চর্য বলে কোনো কিছু নেই’ by মাহমুদুজ্জামান বাবু

মরা মাঝেমধ্যে গান গাইতে ঢাকার বাইরে যাই। এক সময় গায়ক বা শিল্পীদের কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলে সম্মানী দেওয়ার নিয়ম ছিল। এই সময়ে এসে নানা ঘটনা পরম্পরায় এবং বেশকিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার উপসংহারে সম্মানী শব্দটা বদলে দিয়েছি আমি নিজেই। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার ভ্রমণক্লান্তি আর গান গাওয়ার পরিশ্রমের বিনিময় হিসেবে ওটাকে এখন পারিশ্রমিক বলি। সব ক্ষেত্রে সেটিও সব সময় পাওয়া যায় না।


কারণ, আয়োজকদের বাজেট প্রায় সময়ই ‘ফেল’ করে। আমরা যে ধরনের গান করি, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক মিলিয়ে তা প্রধানত দেশাত্মবোধক গান বা গণসংগীতের ধারাকে অনুসরণ করে। তো এ ধরনের গান পরিবেশনের শেষে প্রাপ্তি জোটে কখনো ফুলের তোড়া, কখনো প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি সুন্দর কোনো ক্রেস্ট। এই তো কয়েক দিন আগে এক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে মঞ্চ থেকে নামছি, আমাদের দেশের গুণী শিল্পী সুবীর নন্দী পাশ কাটিয়ে মঞ্চে উঠতে উঠতে আমার হাতে আয়োজকদের দেওয়া ফুলের তোড়া দেখে সহাস্যে বলে উঠলেন, ‘শুধুই ফুল? ফুলে কিন্তু ব্যাকটেরিয়া থাকে।’ আমি তাঁকে আশ্বস্ত করি। ‘না দাদা, ছোট একটা প্যাকেটও দিয়েছে।’ দেশাত্মবোধক গান কিংবা গণসংগীত অনেক দিন করেছেন বা করতেন, যাঁরা নৈতিক অবস্থানে অটল থেকেছেন, যাঁরা রাষ্ট্রশাসক ও কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে নিরলস লড়েছেন, যাঁরা গৌরবের ইতিহাস গড়েছেন, মানুষকে মনুষ্যত্বের দিকে চোখ ফিরিয়েছেন, ইতিহাসের পাতা উল্টে উল্টে এখন দেখতে পাই, চলতে চলতে তাঁদের জীবন কী দুঃসহ দিনরাতই না পার করেছে! শিল্প-সংস্কৃতির যেকোনো শাখাতেই এ একই প্রাপ্তি। কেন?
একুশ শতকের পৃথিবী আজ অন্য রকম। বাংলাদেশও। দুঃসংবাদ হলো, এই অন্য রকমটা ইতিবাচক নয়। নেতিবাচক। খুলনা থেকে যে নৃত্যশিল্পীকে সাতক্ষীরায় নিমন্ত্রণ করে এসেছিল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তাঁদের অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করার জন্য, বাজেট ‘ফেল’ করলে তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে সসম্মানে খুলনা ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারত, অন্য আরও অনেক দিনের মতো সেই শিল্পী দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে বাড়ি ফিরতেন, পরদিন সকালে বা বিকেলে আবার পায়ে নূপুর বাঁধতেন, হয়তো কোনো নৃত্যানুষ্ঠান বা নিয়মিত চর্চার পাটাতনে দাঁড়াতেন, নৃত্য মুদ্রাগুলো চোখে-মুখে আঙুলে বাঙময় হয়ে উঠত, জরা ও মৃত্যুকে অস্বীকার করে জীবন হয়ে উঠত আশাবাদের প্রজাপতি...! সেসব কি আর হবে? ঘুমের ভেতর আঁতকে ওঠার মতো, তীব্র অসম্মানের সেই রাতের কথা তিনি বিস্মৃত হবেন কীভাবে? নূপুর পায়ে বাঁধার কথা মনে হলেই তাঁর মনে পড়বে একটা নির্জন বাড়ির কথা। অনুষ্ঠান শেষে স্বামীসহ তাঁকে সেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাতের খাবার খাওয়ানোর জন্য। মধ্যরাতের সেই ঘরে কোনো খাদ্য ছিল না তাঁর জন্য। অপেক্ষা করছিল কতিপয় খাদক। তিনি নিজেই ছিলেন তাদের খাদ্য। পুঁজিবাদী এই সমাজ আর পুরুষতান্ত্রিক মনের গহিনে নারীর পরিচয় তো এর বেশি কিছু না। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মদদ পাওয়া ছাত্রলীগের সেই পান্ডাদের হাতে কিছুক্ষণ আগের সচল নৃত্যমুদ্রাগুলো মধ্যরাতে নিহত হলো। উৎফুল্ল মনে সেই নৃত্যশিল্পী আর কখনো নাচবেন কি?
স্বাভাবিক মৃত্যুতেও আমাদের শোক হয়। আমরা কাঁদি। বিলাপ করি। স্বজন হারানোর শোক আমাদের ব্যথিত করে। আর অস্বাভাবিক বা অকালমৃত্যুতে আমরা বিক্ষুব্ধ হই। যদি কেউ খুন হয়, আমরা প্রতিবাদে মুখর হই, সমবেত হই, সমস্বার্থে উচ্চকিত হই। সভ্যতা আমাদের তাই শিখিয়েছে। সাতক্ষীরা ও খুলনা থেকে রাজধানী ঢাকা কতদূর? লাঞ্ছনার সেই সংবাদ তো গণমাধ্যম আমাদের কাছে ঠিকই পৌঁছে দিল। এখানে সংস্কৃতিচর্চার হেডকোয়ার্টার। সেই হেডকোয়ার্টারে কত সভাপতি কত সাধারণ সম্পাদক। কত কেন্দ্রীয় কমিটি। শিল্পকলার নানা শাখায় অবদান রাখার জন্য কতজন কত রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন। গুণীজন সম্মাননা পেয়েছেন। ঢাকায় কত নৃত্যসংগঠন, নারী সংগঠন। আমরা কেউ মুখর হলাম না প্রতিবাদে! আমরা কেউ বললাম না সত্যভাষণ। যেন, ও কেবল সাতক্ষীরার বিষয়। যেন, ও কেবল ওই নৃত্যশিল্পীর নিজস্ব লাঞ্ছনা। নাকি, আমরা বলার যোগ্যতা হারিয়েছি। আমরা আমাদের নিজস্ব বুদ্ধি বন্ধক দিয়েছি অন্যের কাছে। শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা, মানুষের ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, নীতি-নৈতিকতা—এসব কথা ও ধারণা এখন কি কেবলই রুদ্ধদ্বার কক্ষের সেমিনারের আলোচ্য বিষয়?
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি লাঞ্ছনাকারী দুজন পান্ডাকে বহিষ্কার করেছে, সাতক্ষীরা জেলা কমিটি বাতিল করেছে। পুলিশ প্রশাসন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করেছে। উচিত ছিল, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে অসম্মানিত নৃত্যশিল্পীর কাছে ক্ষমা চাওয়া। সেটা তারা করেনি। ছাত্রলীগের উপদেষ্টা যাঁরা বা যিনি সেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও তা করেনি। তার মানে, রাষ্ট্র এই অসম্মানকে বৈধতা দিয়েছে। এই রাষ্ট্র মানুষ ও মনুষ্যত্বকে অসম্মান করে, করছে এবং করতে শেখাচ্ছে। সে কারণেই আমরা মৌন ও বধির। একই কারণে ছাত্রলীগ ও ক্ষমতাসীনেরা এমন বেপরোয়া। মৌনতা দিয়ে বেপরোয়া কাউকে আটকানো যায়?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং খুলনা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর লাঠি, রড ও চাপাতিসজ্জিত ছাত্রলীগের নারকীয় হামলার ঘটনা গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী জেনেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে উন্নয়ন ফির নামে বাড়তি টাকা নেওয়ার প্রক্রিয়া প্রতিরোধ করতে চেয়েছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্র জোট। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই অগণতান্ত্রিক এবং স্বেচ্ছাচারিতামূলক উদ্যোগের পক্ষ নিয়ে ছাত্রলীগ সশস্ত্র হামলা করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতা-কর্মীদের ওপর। ছাত্রজোটের নারীকর্মীরাও তাঁদের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন। প্রশ্ন জাগে, উন্নয়ন ফির নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই যে বাড়তি পাঁচ হাজার করে টাকা প্রত্যেক ভর্তিচ্ছু ছাত্রের কাছ থেকে নিতে চাইছেন, তা যদি তারা নিতে পারেন, তাতে ছাত্রলীগের কী লাভ? তাঁরা কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে ওই টাকার ভাগ পাবেন? তা না হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থবিরোধী এই স্বেচ্ছাচারিতার পক্ষ নিয়ে নারকীয় হামলা এবং বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে একটা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে কেন তারা? ক্ষমতা মানে কী? যতদিন ক্ষমতা, ততদিন লুটেপুটে খাও। পাশবিক উন্মত্ততায় দিগ্বিদিক ছুটতে থাকো। বিচার-বিবেচনা-বিবেক আর সমষ্টির স্বার্থের গলায় পা দিয়ে দাঁড়াও?
রাষ্ট্রের চূড়ায় স্বেচ্ছাচার আর অগণতান্ত্রিকতা থাকলে, ক্ষমতার দাম্ভিক চর্চা বিরতিহীন চলতে থাকলে ক্রমান্বয়ে চূড়া থেকে তা নিচের দিকে নামতে থাকে এবং চারদিকে ছড়ায়। একজন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন নিয়ে কত কান্ড হলো, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগও করল, ফল কী দাঁড়াল? মন্ত্রণালয় বদল হলো, আবুল হোসেন হাসিমুখে অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়ে গেলেন। জনগণ কী শিখল? শিখল, ক্ষমতার সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় যদি তোমার পক্ষের লোক থাকে, তোমার কিচ্ছু হবে না। জনগণের মধ্যে ছাত্রলীগের বড় ও পাতি কর্মীও থাকে। সেও তা-ই শিখল। আর শিখল বলেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের স্নাতক চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা শেষে মৃতে পরিণত হলো। এই খুনে বোধ, এই ক্ষমতালিপ্সা আর উচ্ছিষ্টভোগের প্রবণতা ছাত্রলীগ কোত্থেকে পায়? একই দৃশ্যাবলি আমরা দেখেছি অতীতে স্বৈরাচারী সামরিক সরকার এরশাদ ও বিএনপির মূল দল ও তাদের ছাত্র-যুব সংগঠনের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডে। তাহলে কি এটা তারা যে রাজনীতির চর্চা করেন তা থেকে উদ্ভূত? কখনো কখনো কোনো কোনো বামপন্থার দলেও এই প্রবণতা উঁকি দেয়। অথচ তরুণদের শক্তি একদিন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জয়ডঙ্কা বাজিয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান—সবখানেই তরুণদের নৈতিক লড়াইয়ের জয়গান। নিশ্চয়ই তখন এমন একটা বোধ ছিল, যা তারুণ্যকে দিয়েছিল অপরিমেয় সাহস, চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করার চেতনা আর ভয়ের টুটি চেপে ধরার মুষ্টিবদ্ধ হাত। সেই বোধ ও জীবন দৃষ্টিভঙ্গি কোথায় হারাল? কেন এসে কেউ মনের দরজায় টোকা দিয়ে বলছে না, শোনো হে, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।
গুপ্তহত্যা, খুন আর গুম হয়ে যাওয়া লাশগুলো সকাল-দুপুর-রাত খলখল করে হাসে। কী নির্বিকার আমাদের মৌনতা। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর আর তারও আগে মীরসরাইয়ের চুয়াল্লিশজন শিশুর সড়ক দুর্ঘটনায় অমন মর্মান্তিক মৃত্যু কিংবা নিজের মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বরিশালে নিহত মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক জিন্নাত আলীর স্মৃতি ধূসর হতে না হতেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাংবাদিক দীনেশ দাস। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হয়েছে, আমরা আশায় বুক বাঁধি। হোক, অন্তত একটা কিছু নৈতিক হোক। আর তখন একজন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার বলেন, ৪০ বছরে আমাদের যা কিছু অর্জন তা বৈষয়িক, নৈতিক নয়। স্বাধীনতার ৪০ বছর স্মারক অনুষ্ঠানে বিদগ্ধ আলোচকেরা বলছেন, বৈষম্য এখানে দুটি সমাজ সৃষ্টি করেছে। একটি সমাজে নাভিশ্বাস, অন্যটিতে ক্ষমতার দোর্দণ্ড প্রতাপ। একটি সমাজে নিপীড়িতের কান্না, অন্যটিতে নিপীড়কের সদম্ভ হুঙ্কার। তখনও আমাদের কী প্রগাঢ় মৌনতা। খুলনার নৃত্যশিল্পীকে বলছি, বন্ধু, এসব অনাচারকে আমাদেরই রুখে দিতে হবে। কথা বলতে হবে। বাংলাদেশের সব শিল্পীর পক্ষ থেকে, সব মানুষের পক্ষ থেকে আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘এই এক আশ্চর্য সময়। যখন আশ্চর্য বলে কোনো-কিছু নেই।’
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.