পুঁজিবাজারের কাঁটা by ইফতেখার আহমেদ টিপু

হারানো পুঁজি উদ্ধারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কয়েক মাস ধরে মানববন্ধন, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও মিছিলে কোনো কাজ না হওয়ায় তাঁরা আমরণ অনশনের কর্মসূচি দেন। গত সপ্তাহে ঢাকা শেয়ারবাজারের লেনদেন শুরুর আগেই ১৪ দফা দাবি আদায়ে গুটিকয়েক বিনিয়োগকারী মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে ডিএসই ভবনের সামনে অবস্থান নেন।


৩৫ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারীর বিপরীতে অনশনকারীর সংখ্যা সামান্য কয়েকজন হলেও তাঁদের এই প্রতিবাদকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। অনশনকারীদের প্রতি দলমত নির্বিশেষে সব বিনিয়োগকারীর সমর্থন পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি মহল সক্রিয় হয়ে ওঠে। শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নতুনভাবে তোড়জোড় শুরু হয়। সরকার পুঁজিবাজার মনিটরিং ও যেকোনো পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করেছে। এর পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের দাবি অনুযায়ী ব্রোকার হাউসের কমিশন অর্ধেকে নামিয়ে আনা, সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগে কর রেয়াত এবং মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগ আয়করমুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। অনশন কর্মসূচি দৃশ্যত ব্যর্থ হলেও এর মাধ্যমে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের হাহাকারের বিষয়টি আরো ব্যাপক মানুষের মনোযোগ কেড়েছে। অনশনকারীদের প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন ঘোষণা সমস্যার রাজনৈতিকীকরণের শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এটি সরকারের জন্য অশনি সংকেত বলে বিবেচিত হতে পারে।
কোনো কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না বাজারের পতন। বছরখানেক আগে বাজারের সূচক পড়তে শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাজারকে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায়নি। সরকারের কোনো পদক্ষেপ বাজারের পতন ঠেকাতে পারছে না। অব্যাহত দরপতনের কারণে তিন মাসের ব্যবধানে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে (ডিএসই) সাধারণ সূচক কমেছে প্রায় দেড় হাজার পয়েন্ট এবং এ সময়ের মধ্যে ডিএসইতে লেনদেন কমেছে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। ডিএসইর তথ্য মতে, গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে বাজারে ধস নামার পর বাজার পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়ালে ছয় মাসের ব্যবধানে সূচক ছয় হাজার পয়েন্টের ঘর অতিক্রম করে। গত ২৪ জুলাই ডিএসইর সাধারণ সূচক ছিল ৬৭১০ পয়েন্ট। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা ১৪৬২ পয়েন্ট কমে ৫২৫৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। গত ছয় মাসের ব্যবধানে লেনদেন কমেছে এক হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। গত এক বছরের একটানা দরপতনে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। অনেকেই নিজেদের বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তিত। লভ্যাংশ দূরের কথা, নিজেদের বিনিয়োগ করা মূলধন হারিয়েছেন অনেকে_এমন অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। শেয়ারবাজারের এই অস্থিরতা নতুন কিছু নয়। মুনাফার লোভেই এখানে বিনিয়োগ হয়। অনেক বিনিয়োগকারী মনে করেন, শেয়ারবাজারে টাকা খাটালেই নগদে প্রচুর লাভ পাওয়া যায়। বিনিয়োগকারীরা বাজারকে লাভের বাজার বলেই মনে করেন। কিন্তু শেয়ারবাজারে টাকা বিনিয়োগ করলেই যে শুধু লাভ হবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।
এটাও ঠিক যে শেয়ারবাজারের বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই এখানে বিনিয়োগ করেন না জেনে, না বুঝে। অনেকে স্বল্প সময় টাকা খাটিয়ে লাভ তুলে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু শেয়ারবাজার স্বল্প সময়ের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র নয়_এটা বিনিয়োগকারীদের জানতে হবে। তাঁদের জানতে হবে, এই বাজারে ব্যবসা করলে সেখান থেকে লাভ আসবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু বাজার যেন অস্বাভাবিক হয়ে না ওঠে, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। হঠাৎ বাজার স্ফীত হয়ে ওঠাটা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এর পেছনে যে ফটকাবাজারিদের হাত থাকে সেটা সবাইকে বুঝতে হবে। সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে। শেয়ারবাজারের জন্যও একটি নিয়ম থাকা জরুরি। বিশেষ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যেন কোনোভাবেই বিভ্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে দিকটি লক্ষ রাখতে হবে। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। বাজারে যারা ফটকাবাজারি করে টাকা তুলে নিয়ে যেতে চায়, তাদের দিকে নজরদারি প্রতিষ্ঠানের কড়া দৃষ্টি থাকতে হবে। আর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার আগে সবাইকে বাজার বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। পুঁজিবাজারের সার্বক্ষণিক মনিটর এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করেছে সরকার। ছয় সদস্যের এই উপদেষ্টা কাউন্সিলের আহ্বায়ক থাকছেন অর্থমন্ত্রী। অন্য সদস্যরা হচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ, এসএসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকি এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আনিসুল হক। সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব। সরকার ধারণা করছে, পুঁজিবাজারের টানা দরপতন ঠেকাতে এই উপদেষ্টা কাউন্সিল ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আমরণ অনশন শেয়ারবাজার সংকটের সমাধানের পথ নয়। তবে পাশাপাশি এটিও সত্যি, সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা এদিকে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। কাদের কারসাজিতে বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়েছেন তাদের খুঁজে বের করতে হবে। যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বিনিয়োগকারীরা অনশনে নামতেই শুধু বাধ্য হননি, সরকারের প্রতি এক বিশাল জনগোষ্ঠীর আস্থার ক্ষেত্রেও সংশয় সৃষ্টি করেছে। সরকার বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে এবং শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে ইতিবাচক পদক্ষেপের পাশাপাশি লুটেরাচক্রের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক নবরাজ,
চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.