চরাচর-আমরা অতিথি পাখির ক্ষেত্রে অতিথিপরায়ণ নই by সাইফুল ইসলাম খান

তিথিপরায়ণ জাতি হিসেবে বাঙালির সুনাম সর্বজনস্বীকৃত। অতিথিকে আপ্যায়ন ও যথাযথ সেবা করা বাঙালির মজ্জাগত অভ্যাস। কিন্তু প্রতিবছর সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসা অতিথি পাখিদের প্রতি আমাদের ব্যবহার অনেকটাই তার ব্যতিক্রম। হাজার হাজার মাইল আকাশপথ পাখায় ভর করে উড়ে আসা এই অতিথি পাখিরা বা মাইগ্রেটরি বার্ড আমাদের দেশে আসে জীবন বাঁচাতে।


প্রচণ্ড শীত, তুষারপাত ও খাদ্যাভাবের কারণে সাইবেরিয়ায় পাখিদের জীবন ধারণ হুমকি সম্মুখীন হলে তারা ছুটে আসে আশ্রয় লাভের আশায়। এ ছাড়া আরো দুই ধরনের অতিথি পাখি আসে আমাদের দেশে লোকাল মাইগ্রেটরি ও সামার ভিজিটর। এই দুই ধরনের পাখিরা আসে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে। তবে শীতকালে অধিকসংখ্যক পাখি দূরদেশ থেকে আসে বলে অতিথি পাখি বলতে আমরা সাধারণত শীতকালে আসা পাখিদের উল্লেখ করি। বালিহাঁস, বিভিন্ন ধরনের সরালিসহ এই পাখিদের প্রজাতির সংখ্যা ২৪০টি। অতিথি পাখিরা মুক্ত জলাশয় ও হাওরে আশ্রয় নেয়। সবচেয়ে বেশি পাখি আশ্রয় নেয় টাঙ্গুয়ার হাওর, চলনবিল ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন হাওরে। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক ও চিড়িয়াখানার লেকে প্রচুর অতিথি পাখি দেখা যায়। এই অতিথি পাখিদের আসার ব্যাপারটিও অত্যন্ত বিস্ময়কর। এই পাখিরা হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয় একনাগাড়ে। এরপর তারা আমাদের দেশের জলাশয়ে আশ্রয় নেয়। শীতের শেষে যখন তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তখন তারা আবার ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। কিন্তু যে পাখিগুলো আসে, তারা সবাই কি ফিরে যেতে পারে? পারে না। একশ্রেণীর মুনাফালোভী দুষ্ট প্রকৃতির মানুষের হাতে এখানে তারা প্রাণ বিসর্জন দেয়। অতিথি পাখিদের অস্থায়ী আশ্রয়স্থল জলাশয় থেকে তাদের ধরে এনে বিক্রি করে দেওয়া হয় বিকৃত স্বাদভোগী কিছু মানুষের কাছে। প্রতিবছর শীতে ঢাকার রাজপথে অতিথি পাখিদের বেচাকেনার দৃশ্য এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। এ ছাড়া ঢাকার আশপাশেও এই হতভাগ্য পাখিদের বিক্রি হতে দেখা যায়। যদিও অতিথি পাখি শিকার করা আইনসিদ্ধ নয়। পৃথিবীতে ৯ হাজারের বেশি পাখি থাকলেও বাংলাদেশে বাস করে মাত্র ৬৫০টি প্রজাতি। এদের মধ্যে ৮২টি প্রজাতির পাখির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। ইতিমধ্যে পিনক-হেডেড ডাক ও কমন পিফউল নামের দুটি প্রজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। পৃথিবীতে মাইগ্রেটরি বার্ডের সংখ্যা এক হাজার ৮০০ হলেও শীতকালে বাংলাদেশে আসা ২৪০টি প্রজাতি পাখির মধ্যে ১২ প্রজাতির পাখির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। হুমকির মধ্যে থাকা এই পাখিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এখন শুধু আমাদের আইনগত বাধ্যবাধকতা নয়, নৈতিক দায়িত্বও বটে। সামান্য একটু পাখির মাংস খাওয়ার লোভে যেন অতিথি পাখিদের আমরা হত্যা না করি। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে কমে আসবে অতিথি পাখি নিধন। সর্বোপরি শিকারিরা যাতে অবাধে অতিথি পাখি শিকার করতে না পারে, এ ব্যাপারে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.