আস্থা ভোটের আগে গিলানি-গণতন্ত্র না স্বৈরশাসন সেই সিদ্ধান্ত নিন

পাকিস্তানে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্বের মুখে আগামী সোমবার পার্লামেন্টে আস্থা ভোট ডেকেছে গিলানি সরকার। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি বলেছেন, দেশে গণতান্ত্রিক সরকার থাকবে, নাকি আবার সামরিক শাসন শুরু হবে— পার্লামেন্টকে এখন সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।


বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সরকার পতনের চেষ্টাকারীদের গণতন্ত্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে নিজের সরকারকে রক্ষা করতে পারবেন বলে আশা করছেন গিলানি। তবে আস্থা ভোটে তিনি জিতবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে।
‘আস্থা ভোটের প্রয়োজন নেই’: গতকাল শুক্রবার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী গিলানি বলেন, আস্থা ভোটের প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন না। এর পরও কেউ যদি আস্থা ভোট চান, তাহলে তাঁরা সেটা করতে পারেন।
পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী এমপিদের উদ্দেশে বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র থাকবে নাকি স্বৈরতন্ত্র, এ সিদ্ধান্তই এখন আমাদের নিতে হবে। যদি আমরা কোনো ভুল করি, তাহলে তার জন্য গণতন্ত্র বা পার্লামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
গিলানি আরও বলেন, সবার উচিত সংবিধানকে সম্মান করা। কেউ যদি প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ হ্রাস করতে চান, তাহলে তাঁদের উচিত সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপন করা।
সরকার প্রেসিডেন্ট জারদারিসহ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা নতুন করে চালু করার পদক্ষেপ না নিলে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট দুজনকেই অযোগ্য ঘোষণা করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে বলে সুপ্রিম কোর্টের হুমকির পর পার্লামেন্টের এই বিশেষ অধিবেশন ডাকে গিলানি সরকার। আস্থা ভোটের নির্ধারিত দিন সোমবারই সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া সময় অনুযায়ী দুর্নীতির মামলা পুনরুজ্জীবিত করার শেষ দিন।
সেনাবাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী গিলানি পার্লামেন্টকে জানান, সরকারের অবস্থান কোনো প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে নয়। তিনি বলেন, ‘এখন নতুন কোনো পক্ষ যদি দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে সেটা সরকার বা বর্তমান বিরোধী—কারও পক্ষেই যাবে না।’
দৃশ্যত বিচার বিভাগকে তুষ্ট করার চেষ্টায় গিলানি বলেন, ‘বিচারকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে আমরা জেলে গিয়েছিলাম...প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর পক্ষে কথা বলে রাষ্ট্রদ্রোহী হয়েছিলাম।’
শরিকদের সমর্থন পেতে তৎপর পিপিপি: সোমবারের আস্থা ভোটে শরিক দলগুলোর সমর্থন পেতে জোর তৎপরতা শুরু করেছে ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান দল জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। তবে কিছু শরিক দল বলেছে, সেনাবাহিনীকে বেশি চাপ দেওয়া সরকারের পক্ষে উচিত হবে না। বড় একটি শরিক দলের এক এমপি বলেন, ‘আস্থা ভোটের প্রস্তাবে আমরা সরকারকে সমর্থন দেব। কেননা, এতে দেশের গণতন্ত্র মজবুত হবে।’ তবে সেনাবাহিনীকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে প্রস্তাব তোলা হলে তা সমর্থন করা কঠিন হবে।’
দেশে ফিরেছেন জারদারি: গুঞ্জনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি গতকাল সকালে দেশে ফিরেছেন। এক দিনের সফরে বৃহস্পতিবার তিনি দুবাই গিয়েছিলেন। দেশের এই অবস্থায় হুট করে প্রেসিডেন্ট বিদেশ যাওয়ায় নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই প্রেসিডেন্ট দুবাই যাচ্ছেন।
সরকারের প্রতি মার্কিন সমর্থন: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন জানিয়েছেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় তাঁর দেশ উদ্বিগ্ন। তবে তিনি আশা করছেন, সরকার সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে পারবে, যাতে সে দেশের বেসামরিক সরকার শক্তিশালী হবে।
হিলারি বলেন, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো সমর্থন আছে। তবে তাদের অবশ্যই সমস্যার ‘আইনসংগত ও স্বচ্ছ’ সমাধান করতে হবে।
ব্রিটিশ কূটনীতিককে গিলানির ফোন?: যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানের দুই সরকারি কর্মকর্তা গতকাল বলেন, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের আশঙ্কায় যুক্তরাজ্যের সাহায্য চেয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যাডাম টমসনকে চলতি সপ্তাহে ফোন করেছিলেন গিলানি। তবে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর—উভয়েই গতকাল এ ধরনের ফোনের কথা অস্বীকার করেছে।
সব জানিয়ে দেবেন ইজাজ: এদিকে ‘মেমোগেট’ কেলেঙ্কারির জন্মদাতা মনসুর ইজাজ জানিয়েছেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি যে সেনাবাহিনীর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন, সে প্রমাণ তাঁর (ইজাজ) কাছে আছে। এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি পাকিস্তানে ফিরতে প্রস্তুত আছেন।
সুইজারল্যান্ড থেকে টেলিফোনে যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্যবসায়ী ইজাজ বলেন, ঝুঁকি থাকলেও খুদেবার্তার রেকর্ড নিয়ে তিনি পাকিস্তানে যাবেন।
গোপন ওই চিঠির ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য ইজাজকে তলব করেছেন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট।
কার্যত মনসুর ইজাজের মাধ্যমেই পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এ ব্যবসায়ী গত অক্টোবরে সংবাদপত্রে লেখা নিবন্ধে দাবি করেন, সম্ভাব্য অভ্যুত্থান ঠেকাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কাটছাঁট করতে মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের কাছে তাঁকে দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট মার্কিন সেনা কর্মকর্তা কথিত চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, তাঁরা এ বিষয়ে সাড়া দেননি। এ ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার ও প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় নেমে এসেছে।

No comments

Powered by Blogger.