রঙ্গব্যঙ্গ-রনির কাল্পনিক সাক্ষাৎকার by মোস্তফা কামাল

জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগদলীয় সদস্য গোলাম মাওলা রনি। তিনি নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত। অভিযোগ আছে, রনি তাঁর এলাকায় একজন গডফাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বিভিন্ন দখলের সঙ্গেও তিনি জড়িত। অতিসম্প্রতি তিনি আবুল হোসেনের যোগাযোগমন্ত্রী হওয়ার গল্প (যোগাযোগমন্ত্রীর ভাষায়) শুনিয়ে আবার আলোচনায় এসেছেন।


তাঁর সেই গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে। আর এ কারণে তিনি তুখোড় সমালোচনার মুখেও পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে আমরা এমপি রনির একটি কাল্পনিক সাক্ষাৎকার পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি।
প্রশ্ন : রনি সাহেব, কেমন আছেন?
রনি : ভালো নেই। মহাদুর্যোগের কবলে পড়েছি।
প্রশ্ন : মানে!
রনি : প্রধানমন্ত্রী নাকি আমার ওপর ভয়ানক খেপেছেন। আমাকে নাকি তিনি মীরজাফর বলে আখ্যা দিয়েছেন। বলেন তো ভাই, আমাকে মীরজাফর বলার মানে কী! আমি কথায় কথায় একটা কথা বলে ফেলেছি। সে জন্য এত খ্যাপার কী মানে হয়! প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তো সরলতা আছেই! এ কথা কে না জানে! আমি বলে ফেললাম বলে আমার দোষ হয়ে গেল! আমি বুঝতে পারছি, আমাদের গণতন্ত্র হলো বাকস্বাধীনতা হরণের গণতন্ত্র। একনায়কতন্ত্রও বলা যেতে পারে। অর্থাৎ একজনে বলবেন। বাকিরা জি হুজুর-জি হুজুর করবেন। কিন্তু কিছু বলতে পারবেন না।
প্রশ্ন : আপনি আসলে কী বলেছিলেন?
রনি : কেন, পত্রিকায় দেখেননি?
প্রশ্ন : দেখেছি। তার পরও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। পত্রিকায় ভুলও তো লিখতে পারে!
রনি : আরে ভাই, আপনি পত্রিকার লোক হয়ে পত্রিকার রিপোর্টকে সন্দেহ করছেন? সঠিক লিখেছে। আমি যা বলেছি, তা-ই লিখেছে। শেখ হাসিনা তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী। চীন সফরে গিয়েছিলেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের এবং সৈয়দ আবুল হোসেন। তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁদের এক দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বললেন। তারপর বললেন, যিনি দৌড়ে প্রথম হবে তাঁকে মন্ত্রী বানানো হবে। সেই দৌড়ে আবুল হোসেন প্রথম হন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে তাঁকে মন্ত্রী বানান।
প্রশ্ন : আপনার এই বক্তব্যকে আবুল হোসেন গল্প বলে মন্তব্য করেছেন।
রনি : মোটেই গল্প না। সত্য, হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্য ঘটনা। তা ছাড়া সাবের ভাই, কাদের ভাই তো বেঁচে আছেন। তাঁদের কাছেই জিজ্ঞাসা করুন। তাঁরা যদি বলেন আমি গল্প বলেছি, তাহলে নাকে খত দেব। প্রয়োজন অন্য যেকোনো শাস্তি ভোগ করতে রাজি আছি।
প্রশ্ন : আপনি মন্ত্রীদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
রনি : জি। এই প্রশ্ন আমি এখনো তুলছি। মন্ত্রিসভায় কয়জন মন্ত্রী যোগ্য? বেশির ভাগই তো অযোগ্য। কোনো কাজ জানেন না। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে দায়িত্ব দিক, দিনবদল কাকে বলে আমরা দেখিয়ে দেব!
প্রশ্ন : মন্ত্রিসভায় অনেকেই তো তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি! তাঁরা পারছেন না কেন?
রনি : তাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড কী, সেটা দেখতে হবে। মন্ত্রণালয় চালানোর মতো মেধা আছে কি না দেখতে হবে। বেশির ভাগই হলো প্রধানমন্ত্রীর খাস চামচা! থুক্কু, (ভাই! এই কথাটা লিখবেন না। এমনিতেই বিপদে আছি। এই কথা শুনলে আর রক্ষা নেই। স্রেফ কাঁচা গিলে খাবে!) বেশির ভাগই অযোগ্য। এ কারণে তাঁরা অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে পড়েছেন। কোনো দিকনির্দেশনা তাঁরা দিতে পারেন না। সব কিছুতেই প্রধানমন্ত্রীকে নাক গলাতে হয়। এ কারণেই সরকারের কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে। ভাই, এই কথাটাও লিখবেন না। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। জানেন, আমার মুখটাই হলো বড় সমস্যা। কোনো কথা পেটে রাখতে পারি না। তবে এটাও তো ঠিক। সরকার ভালো কাজ না করলে এলাকায় আমরা মুখ দেখাতে পারি না। আমাদের কথা শুনতে হয়। টিভির টকশোগুলোতে সরকারকে তুলাধুনা করা হয়। সরকার ভালো করলে তো পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না, তাই না?
প্রশ্ন : আপনারা এমপিরা কী ভালো করছেন? আপনারাও তো দুর্নাম ছড়াচ্ছেন!
রনি : আপনি আমার এলাকায় গিয়ে দেখুন। আমার নাম এলাকার সবার মুখে শুনতে পাবেন। আমরা কিছু কাজ করছি বলেই তো সরকার টিকে আছে!
প্রশ্ন : এলাকায় আপনার পরিচিতিটা পজিটিভ না নেগেটিভ?
রনি : পজিটিভ-নেগেটিভের চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আপনাকে মানুষ চেনে কি না! আমি বলব, ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে একজন রনিকে সবাই চেনে! ব্যস, আমার আর কিছুই দরকার নেই।
প্রশ্ন : তাই!
রনি : আপনিই বলেন, সংসদে ৩০০ জন নির্বাচিত এমপি (অনির্বাচিতরা তো প্রধানমন্ত্রীর পছন্দে হয়ে থাকেন) আছেন। আপনি কয়জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন?
প্রশ্ন : খুবই কমসংখ্যক।
রনি : তাহলে! আমি রনি, তাই আপনি সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন। আমি রনি হয়ে না উঠলে নিশ্চয়ই আপনি আসতেন না!
প্রশ্ন : তার মানে আপনি নেগেটিভ-পজিটিভকে আলাদাভাবে দেখছেন না?
রনি : আরে ভাই! সবাই কি আর নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে! আমি তাই ভিলেনের চরিত্র বেছে নিয়েছি। আর ভিলেন হলে তো কিছু নেতিবাচক দিক থাকবেই!
প্রশ্ন : বুঝতে পারছি। আপনি সব সময় আলোচনায় থাকতে চান?
রনি : জি জি। ঠিক ধরেছেন।
প্রশ্ন : এ কারণেই কি দখলের রাজনীতি?
রনি : আরে, পুরো দেশটাই তো দখল হয়ে গেছে। আমি চুনোপুঁটি মানুষ না হয় একটু-আধটু করলামই! তাতে অসুবিধা কী?
প্রশ্ন : পুরো দেশ দখল মানে!
রনি : কেন, দুই নেত্রী পুরো দেশ দখল করে নিয়েছেন না? আমার মনে হয় কি জানেন? দুই নেত্রীর মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক লোক দেখানো। ভেতরে ভেতরে তাঁদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক!
প্রশ্ন : কী রকম?
রনি : তাঁরা প্রতি পাঁচ বছর অন্তত দেশ চালাবেন। পাঁচ বছর শেখ হাসিনা, পাঁচ বছর খালেদা জিয়া। তারপর তাদের বংশপরম্পরায় ক্ষমতার পালাবদল চলতে থাকবে। তার মানে কী দাঁড়াল! দুই পরিবারের হাতে দেশ দখল হয়ে গেল না! হা হা হা! এবার যান। আমার কথাটা চিন্তা করে দেখেন!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.