বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৮৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. শাহ আলম, বীর উত্তম সফল অপারেশনের কৌশলী দলনেতা মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা নির্ধারিত তারিখে বন্দরে অবস্থানরত জাহাজ মাইনের সাহায্যে ডুবিয়ে দেবেন। এ জন্য অপারেশনের আগে দিনের বেলায় বন্দর ও আশপাশের এলাকা সরেজমিন রেকি (পর্যবেক্ষণ) করা প্রয়োজন। দায়িত্বটা বেশ কঠিন।


রেকিতে ভুল হলে মারাত্মক বিপদ হতে পারে। নৌ-কমান্ডোদের একটি দলের দলনেতা মো. শাহ আলম সিদ্ধান্ত নিলেন, এ দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করবেন। দক্ষতার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করে তিনি গোটা অপারেশন সফল করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অন্য দিকে সারা বিশ্বে এ ঘটনা তোলপাড় তুলল। ১৯৭১ সালের মধ্য আগস্টে এ ঘটনা ঘটেছিল চট্টগ্রামে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ ঐতিহাসিক এক ঘটনা। ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো অভিযান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা এবং বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে। এর আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরে অভিযানের জন্য তিনটি দলের সমন্বয়ে কমান্ডো দল গঠন করা হয়। একটি দলের দলনেতার দায়িত্ব পান মো. শাহ আলম। এ অভিযানে অংশ নেওয়ার জন্য তাঁরা ভারতের পলাশি প্রশিক্ষণঘাঁটি থেকে ২ আগস্ট চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হন। কথা ছিল, ১৩ ও ১৪ আগস্ট আকাশবাণী বেতারকেন্দ্র থেকে গানের মাধ্যমে দুটি ঘোষণা দেওয়া হবে। ঘোষণা দুটি শোনার পরই কমান্ডোরা অপারেশন করবেন। ঘোষণা দুটির প্রথমটি হলো পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া একটি গান, ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান।’ এ গান শোনার সঙ্গে কমান্ডোরা অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে থাকবেন। দ্বিতীয় ঘোষণা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান, ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি।’ এ গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডোরা প্রস্তুতি শেষ করে ওই দিন মধ্যরাতে পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক অপারেশন করবেন। এ সংকেত শুধু সমন্বয়ক ও দলনেতাই জানতেন, বাকিরা জানতেন না।
নৌ-কমান্ডোরা আগরতলা হয়ে ৮ আগস্ট ১ নম্বর সেক্টরের হরিণা ক্যাম্পে পৌঁছান। সেদিন রাতেই তাঁরা বাংলাদেশে ঢোকেন। নৌকা যোগে ও হেঁটে ১৩ আগস্ট তাঁরা চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছান। পরে শহরের ভেতরে বিভিন্ন নিরাপদ বাড়িতে আশ্রয় নেন। হরিণা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসার পথ ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক।
চট্টগ্রাম শহরের সবুজবাগ হোটেলটি ছিল নৌ-কমান্ডোদের সম্মিলনকেন্দ্র। অপারেশনের আগে চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান, তাদের গতিবিধি, বন্দরে কয়টি জাহাজ থাকবে, বয়রাগুলোর অবস্থান ইত্যাদি জানা এবং কর্ণফুলীর টাইটাল চার্ট সংগ্রহ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এ কাজ করা ছিল তখন অত্যন্ত দুরূহ। কাজটি মো. শাহ আলমই দক্ষতার সঙ্গে করেন।
১৫ আগস্ট মধ্যরাতে (ঘড়ির কাঁটা অনুসারে তখন ১৬ আগস্ট) নৌ-কমান্ডোরা সফলতার সঙ্গে অপারেশন করেন। এতে ১০টি টার্গেট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস বা নিমজ্জিত হয়। এগুলো ছিল জাহাজ, গানবোট, বার্জ ও পল্টুন। চট্টগ্রাম বন্দরের ভয়াবহ অপারেশনের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম এ ঘটনা ফলাও করে প্রচার করে।
মো. শাহ আলম ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পরে ভারতে গিয়ে নৌ-কমান্ডো বাহিনীতে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. শাহ আলমকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৫৭।
মো. শাহ আলম ১৯৮৫ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার করমুল্লাপুর গ্রামে। তবে সেখানে তিনি থাকতেন না। বসবাস করতেন চট্টগ্রাম মহানগরে। স্বাধীনতার পর এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম মো. আলী আহম্মদ চৌধুরী, মা জমিলা খাতুন, স্ত্রী নাদিরা আলম। তাঁর এক মেয়ে।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ১০।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.