প্রতিক্রিয়া-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী পাওয়া যায় নাকি দেওয়া হয়? by তুহিন ওয়াদুদ

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী পাওয়া যায় নাকি দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অল্প দিন পরেই এ কথা শুনেছিলাম। শুনে প্রথম অবস্থায় মানতে পারিনি। কিন্তু যখন বিভিন্ন বিভাগের বন্ধু-বড় ভাই সবার কাছে এ কথা শুনতে থাকি, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম বিবেকবর্জিত কার্যকলাপের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ঘৃণা জন্মেছিল।


বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে যাদের অধিক ওঠা-বসা, তাদের সম্পর্কেও একটা নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়। আস্তে আস্তে সেই বাস্তবতার নগ্ন প্রকাশ দেখে খুবই আহত হতে থাকি। আমরা বন্ধুরা মিলে তখন মনের দুঃখে জীবনানন্দ দাশ আওড়াতাম ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ চোখে দেখে আজ তারা সব চেয়ে বেশি’। আমাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের মেয়ে পড়ত। প্রথম বছর ফল প্রকাশে দেখা গেল সে খুব ভালো করেছে। আমাদের এক সাহসী বন্ধু এ দেখে তাকে বলেছিল, ‘তুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সন্তান না হলে পাস করতে পারতিস না। অথচ তুই এত ভালো ফল করেছিস!’ অপমানে-অভিমানে সে তার বাবাকে অভিযোগ করার কথা বলেছিল। যাহোক, অল্প কয়েক দিন পর তার বাবা অবসরে যাওয়ার কারণে তাকে নিয়ে আর কাউকে অতি আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের কয়েক দিন আগে পরীক্ষা কমিটির সভাপতি আমাদের পরের ব্যাচের এক শিক্ষার্থীকে আমাদের ব্যাচের এক শিক্ষার্থী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ছেলেটি খাতায় লেখে ভালো, কিন্তু কোনো যোগাযোগ করে না।’ ফল প্রকাশে সামান্য কম নম্বরের কারণে তার প্রথম শ্রেণী হয়নি। তখন আমাদের সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম শ্রেণী কোনো ব্যাচে দেওয়া হতো, কোনো ব্যাচে দেওয়াই হতো না। আর ইংরেজি বিভাগে প্রচুরসংখ্যক তৃতীয় শ্রেণী দেওয়া হতো। আমাদের এক বন্ধু তার এক শিক্ষককে সাহস করে বলেছিল, ‘স্যার, কী রকম করে লিখলে ১০০ নম্বরের মধ্যে ১০০ পাওয়া যায়? একটা প্রশ্নের উত্তর যদি লিখে দেখাতেন। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো করে আমি লিখে দিতে পারব।’ শিক্ষক তখন বিষয়টি তাঁর একার নয় বলে মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই যে প্রথম শ্রেণী দেওয়া কিংবা ক্ষোভ প্রকাশের জন্য প্রাপ্ত ফলের চেয়ে নিচে নামিয়ে দেওয়া, এটা শুধু একজন শিক্ষার্থীকে ফলাফল থেকে বঞ্চিত করা নয়। এটার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেও হুমকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন অনেক সত্য কথা ফেল করার ভয়ে বলতে পারিনি।
এখন শুনছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কোনো বিভাগের শিক্ষার্থী যদি কোনো সততার জায়গা থেকে কোনো আন্দোলনে যায় এবং তা যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে প্রশাসন ওই সব বিভাগের শিক্ষককে দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আন্দোলন থামানোর ব্যবস্থা করে। সব শিক্ষকের কাছে যে কলম অস্ত্র, তা নয়। আমরা দেখেছি, যেসব শিক্ষক পড়ান ভালো, যাঁদের মধ্যে শিক্ষার আলো রয়েছে, তাঁরা এমনতর ভয়ংকর হয়ে ওঠেন না, তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক যতই থাকুক না কেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় তাঁরা পক্ষপাতদুষ্ট হন না। এ রকম শিক্ষকদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অকুণ্ঠ এবং আকণ্ঠ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক শিক্ষার্থী মূলত দ্বিতীয় শ্রেণী পেলেও শিক্ষকদের বিশেষ সহযোগিতায় তাকে প্রথম শ্রেণী দেওয়া হয়। এ খবরটি জাতীয় দৈনিকগুলোয় প্রকাশিত হয়, কিন্তু এসব ঘটনায় উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ওই একই ব্যাচে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হওয়া ছাত্রটিকে প্রথম শ্রেণী দেওয়া হয়নি। তাকে যে প্রথম শ্রেণী দেওয়া হয়নি বলে তার একটি দাবি ছিল, তা তার পরবর্তী জীবনের কর্মক্ষেত্রের সফলতা দেখলে বোঝা যায়। তার এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে সে বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। শুধু তাই নয়, পরবর্তী বিসিএস পরীক্ষায় সে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিও করছে। একটি প্রথম শ্রেণীর অভাবে ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির আবেদন করার যোগ্যতা হারিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী পাওয়া যায় আবার অনেক সময় প্রথম শ্রেণী দেওয়া হয়। এত করে শিক্ষকদের সুনাম রক্ষা করার উপায় থাকে না। কখনো শিক্ষকদের রেষারেষির কারণে রোষানলে পড়ে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নেমে যায়, কখনো শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীর ছোটখাটো কোনো ভুলের দায়ে ভুল সংশোধনের পরিবর্তে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে নম্বর কম দেওয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আবার কখনো শিক্ষার্থীর অতি আনুগত্যে অন্ধত্বকে বরণ করে যোগ্যতার অধিক নম্বর প্রদান করেন। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে কী শিখবে? তারা তাদের শিক্ষার্থীর কাছে গিয়ে কোন আদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করবে?
এই ঘটনাগুলো সব সময়ে ঘটে থাকে। কিন্তু এই সময়ে লেখার কারণ হচ্ছে, জাতীয় দৈনিকগুলোতে লক্ষ করলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ৫২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৬ জন শিক্ষার্থীকে প্রথম শ্রেণী দেওয়া হয়েছে। কত আপত্তিকর শব্দের প্রয়োগ, অথচ তা-ই সত্যি। শিক্ষার্থীরা ফল অর্জন করেছে, না বলা হচ্ছে তাকে দেওয়া হয়েছে। এই কথা লিখতে হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক উপাচার্যের মেয়েকে প্রথম শ্রেণী পাইয়ে দেওয়ার জন্য একবার কিছু শিক্ষকের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছিল বলে জানি। তার পরও সেই উপাচার্যের মেয়েকে প্রথম শ্রেণী দেওয়া হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৪ সালে ৫২ জনকে, সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৭ সালে ৪৬ জনকে এবং এ বছরে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ৫২ জনের মধ্যে ২৬ জনকে প্রথম শ্রেণী দেওয়া শিক্ষকদের কৃতকর্মের ফল। তা না হলে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সম্মান এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ফলে এত পার্থক্য হবে কেন।
এ অবস্থা শুধু একক কোনো বিভাগ কিংবা একক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় নয়, বরং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি বিভাগে কমবেশি এই বাস্তবতা রয়েছে। শিক্ষিত হওয়ার অর্থ যদি হয় আলোকিত হওয়া, তাহলে একজন শিক্ষক যখন এমনতর গর্হিত কাজ করেন, তখন তাঁকে কি শিক্ষিত হওয়া বলা যায়? তাহলে অন্ধের হাতে আমাদের অন্ধকে আলো দান করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে?
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.