শেষ বলের ছক্কায় জয়

শেষ বলে রুদ্ধশ্বাস জয়ের নজির অনেক। আছে শেষ বলে বাউন্ডারি মেরে জেতার কীর্তিও। কিন্তু শেষ বলে ছক্কা মেরে জয়! আন্তর্জাতিক ম্যাচে তেমন একটা না ঘটলেও টোয়েন্টি-টোয়েন্টিতে হচ্ছে হরহামেশা। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগেই তো শেষ বলের ছক্কায় জিতেছে কয়েকটা দল। সর্বশেষ গ্রুপ 'বি'র শেষ ম্যাচে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর কার্তিক শেষ বলে ছক্কা মেরে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছেন সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। আন্তর্জাতিক ম্যাচে এ ধরনের কয়েকটি জয় নিয়ে এ আয়োজন।
* জাভেদ মিয়াঁদাদ (বিপক্ষ ভারত, ১৯৮৬)
শেষ বলে ছক্কার জয়গুলোর মধ্যে এটাই হয়তো সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছে ক্রিকেট সমর্থক। পাকিস্তান বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তি হলেও ১৯৮৬-র আগে জেতেনি আন্তর্জাতিক কোনো শিরোপা। সেই আক্ষেপটা দূর হয় ১৯৮৬ সালের অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনাল জিতে, তাও আবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে হারিয়ে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ভারত করেছিল ২৪৫। জয়ের জন্য শেষ বলে পাকিস্তানের দরকার পড়ে ৪ রান। ক্রিজে তখন ১১০ রানে অপরাজিত জাভেদ মিয়াঁদাদ। আর বল হাতে বিশ্বকাপের হ্যাটট্রিকম্যান চেতন শর্মা। সেই ম্যাচে ৩ উইকেট নেওয়া শর্মা স্নায়ুর চাপে ভুগেই হয়তো শেষ বলটা দিয়ে বসেন ফুলটস। যা স্কয়ার লেগ দিয়ে ছক্কা মেরে পাকিস্তানকে ঐতিহাসিক জয় এনে দেন ১১৪ বলে ৩ বাউন্ডারি ৩ ছক্কায় ১১৬ রানে অপরাজিত থাকা 'বড়ে মিয়াঁ'। এই ছক্কার ২৫ বছর পূর্তিতে চেতন শর্মা বলেছিলেন, 'বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক আছে আমার। টেস্ট, ওয়ানডেতে উইকেটও একেবারে কম পাইনি। কিন্তু সবাই আমাকে মনে রেখেছে সেই ছক্কা খাওয়া বোলার হিসেবে!' মনে তো রাখবেই, শেষ বলে ছক্কা মেরে ওয়ানডেতে জেতার ঘটনা যে প্রথমবার ঘটেছিল সেবারই।

* ল্যান্স ক্লুজনার (বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, ১৯৯৯)
বৃষ্টিতে নেপিয়ারে অনুষ্ঠিত হওয়া সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডের পরিধি কমে দাঁড়িয়েছিল ৪০ ওভারে। নিউজিল্যান্ড ১৯১ রানে গুটিয়ে গেলেও লড়াই করছিল তা নিয়ে। গিবসের ৫২ আর কালিনানের ৬১-র পরও জয়ের জন্য শেষ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ১১ রান। ডিয়ন ন্যাশের করা সেই ওভারে মার্ক বাউচার ফেরার পর শেষ বলে দরকার পড়ে একটা বাউন্ডারির। যা গ্যালরিতে পাঠিয়ে প্রোটিয়াদের অসাধারণ জয় এনে দেন ১৯ বলে চার বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় ৩৫ করা ক্লুজনার। বলে রাখা ভালো, দক্ষিণ আফ্রিকার পুরো ইনংসে ছক্কা ছিল সেই একটাই!

* ব্রেন্ডন টেলর (বিপক্ষ বাংলাদেশ, ২০০৬)
এখনো হয়তো হারারের দুঃস্বপ্ন তাড়া করে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেটা প্রায় জিতেই গিয়েছিল বাংলাদেশ। কেননা খালেদ মাসুদের দলের ২৩৬ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৪৮ ওভারে ৭ উইকেটে ২০৪ করেছিল জিম্বাবুয়ে। জয়ের জন্য ১২ বলে তাদের দরকার ছিল ২৮ রানের। ৪৯তম ওভারে শাহাদাত ১১ রান দিলেও শেষ ওভারে লক্ষ্যটা দাঁড়ায় ১৭-তে। মাসুদ বল তুলে দেন মাশরাফির হাতে। ফুলটস করা দ্বিতীয় বলটা স্কয়ার লেগ দিয়ে ছক্কা মারেন টেলর। তার পরও চতুর্থ বলটা সেই ফুলটসই দেন মাশরাফি। এর ঠিকানা বাউন্ডারি। জয়ের জন্য শেষ বলে লাগত ৫ রান। অর্থাৎ বাউন্ডারি হলে টাই আর ছক্কা হলে জয়। স্নায়ুর চাপে ভোগা মাশরাফি শেষ বলটাও করেন ফুলটস! যা মিডউইকেটের ওপর দিয়ে গ্যালারিতে পাঠিয়ে জিম্বাবুয়েকে ২ উইকেটের অসাধারণ জয় এনে দেন ৭২ বলে ৭৯ করা টেলর।

* শিবনারায়ণ চন্দরপল (বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, ২০০৮)
টপাটপ টপঅর্ডারের কটা উইকেট পড়বে, তারপর এসে হাল ধরবেন চন্দরপল_ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটাই এভাবে কেটেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক অধিনায়কের। তাই রান রেট বাড়ানোর বদলে তাঁকে বেশি মনোযোগ দিতে হয় ইনিংস গড়ায়। ২০০৮ সালে পোর্ট অব স্পেনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতেও করছিলেন সে কাজটাই। শ্রীলঙ্কার ২৩৫ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ২৮ ওভারে ১১০ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল ক্যারিবীয়রা। ডোয়াইন ব্রাভোকে নিয়ে এরপর ইনিংস মেরামতের লড়াই শুরু চন্দরপলের। ব্রাভো ৩৯তম ওভারে ফেরেন ৩৬ বলে ৩৭ করে। এরপর দেখতে দেখতেই ২১৯ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে বসে উইন্ডিজ। শেষ ওভারে জয়ের জন্য তাদের দরকার ছিল ১৩ রান। চন্দরপল অন্য প্রান্তটা আগলে রাখলেও জয়ের কথা ভাবাটা কঠিনই ছিল তাঁদের জন্য। তারপর আবার শেষ ওভার করতে আসা চামিন্ডা ভাস প্রথম চার বলে দেন মাত্র ৩ রান।
তাই শেষ দুই বলে এক বাউন্ডারি আর একটা ছক্কা মারতেই হতো চন্দরপলকে। ওভার পিচে পড়া পঞ্চম বলটা মিডঅফ দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠান চন্দরপল। শেষ বলে দরকার পড়ে একটা ছক্কার। এ সময়ই ভুলটা করে বসেন ভাস। শেষ বলটা দিয়ে বসেন ফুলটস। 'উপহার'টা পেয়ে কাজে লাগাতে ভুল করেননি ঘরের মাঠে খেলা এ ব্যাটসম্যান। মিডউইকেটে জয়াবর্ধনের মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে ১ উইকেটের রুদ্ধশ্বাস জয় এনে দেন ক্যারিবীয়দের।

* চামারা কাপুগেদারা (বিপক্ষ ভারত, ২০১০)
২০১০ টোয়েন্টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। মর্যাদার মঞ্চ। শ্রীলঙ্কার জন্য ছিল আবার অনন্ত চাপের। সেমিফাইনাল খেলতে দ্বিতীয় পর্বের ম্যাচটিতে হারাতেই হতো ভারতকে। অথচ ভারত দাঁড় করিয়ে বসে ১৬৩ রানের পাহাড়। সেই চাপেই হয়তো ৬ রানের ব্যবধানে দুই ওপেনার হারিয়ে বসে লঙ্কানরা। ৩৩ রান করে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা তিলকরত্নে দিলশান ফেরার সময় স্কোরটা ছিল ৭.৪ ওভারে ৩ উইকেটে ৪৯। জয়ের পথে কাঁটা বাড়ে তাতে। পথটা পরিষ্কারও হতে থাকে অধিনায়ক সাঙ্গাকারার ৩৩ বলে ৪৬ আর ম্যাথুজের ৩৭ বলে ৪৬-এ। জয় আর সেমিফাইনালে খেলতে শেষ ওভারে দরকার পড়ে ১৩ রান। ক্রিজে তখন কাপুগেদারা ও ম্যাথুজ। আশীষ নেহরার প্রথম বলেই ছক্কা মেরে লক্ষ্যটা পাঁচ বলে ৭-এ নামিয়ে এনেছিলেন ম্যাথুজ। কিন্তু তিনি পঞ্চম বলে আউট হওয়ায় শেষ বলে শ্রীলঙ্কার দরকার পড়ে ৩ রান। অর্থাৎ বাউন্ডারি ছাড়া জেতার উপায় নেই। স্ট্রাইকে তখন কাপুগেদারা। নেহরা শেষ বলটা করেন সেই ওভারে তাঁর সর্বোচ্চ ১৩৬.৫ কিলোমিটার/ঘণ্টায়। বাউন্ডারি ছাড়া পথ ছিল না বলে আগে থেকেই ডাউন দ্য ট্র্যাকে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন কাপুগেদারা। তাঁর শটটা লেগেও যায় একেবারে মাঝব্যাটে, যা সুইপার কভারের ওপর দিয়ে চলে যায় গ্যালারিতে। আর শেষ বলের ছক্কায় সেমিফাইনালের টিকিট পায় শ্রীলঙ্কা।

* এডওয়ার্ড রেইনসফোর্ড (বিপক্ষ আয়ারল্যান্ড, ২০১০)
ওয়ানডেতে শেষবার শেষ বলে ছক্কা মেরে জেতার ঘটনা ঘটেছিল গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর। হারারেতে আয়ারল্যান্ডের ২০০ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে রেইনসফোর্ডের শেষ বলের ছক্কায় জয় পায় জিম্বাবুয়ে। ৪৯.৫ বলেই অবশ্য সমান হয়ে গিয়েছিল স্কোরটা। জয়ের জন্য তাই একটা সিঙ্গেল হলেই চলত। কিন্তু ফিল্ডাররা সব ৩০ গজের বৃত্তে চলে আসায় কেভিন ও'ব্রায়ানের ফুলটস করা শেষ বলটা গ্যালারিতে পাঠিয়ে জয় নিশ্চিত করেন তিনি।
জাভেদ মিয়াঁদাদ জেতাতে পারলেও পারেননি আসিফ মুজতবা। শেষ বলে ছক্কা মেরে তিনি অবশ্য টাই করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা! ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে হোবার্টে অস্ট্রেলিয়ার ২২৮ রানের জবাবে শেষ বলে পাকিস্তানের দরকার ছিল ৭ রান। স্টিভ ওয়াহর শেষ বলটা আসিফ ছক্কা মারলে টাই হয়ে যায় ওয়ার্ল্ড সিরিজের চতুর্থ ম্যাচটা। এবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়সূচক রানটা ছক্কা মেরেই নিয়েছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। তবে তখনো ম্যাচের বাকি ছিল ১০ বল।

No comments

Powered by Blogger.